প্রজন্ম ডেস্ক:
জনমত যাচাইয়ের পর নতুন দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে বিভাগভিত্তিক কমিটি গঠন শেষ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। জেলা ও উপজেলায়ও কমিটি গঠনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। এসব কমিটিতে শহিদ পরিবার এবং আহতদের নেতৃত্বে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নতুন দল গঠন করা হলে তার কার্যক্রম, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক, আন্দোলনে অংশ নেওয়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়াসহ নানা সমীকরণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতৈক্য চূড়ান্ত না হওয়ায় অধিকতর আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে গঠন করা হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্ম। এই ব্যানারে ঘোষিত এক দফা কর্মসূচি থেকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। নতুন সরকার গঠন, নেতৃত্ব আর উপদেষ্টা হওয়া নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলে নানা সমীকরণ। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় লিয়াজোঁ কমিটি। এই কমিটি বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকার গঠনসহ নানা কাজে সম্পৃক্ত ছিল।
অন্যদিকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত কার্যত সরকার না থাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নানা ইস্যুতে যুক্ত থাকেন শিক্ষার্থীরা। আবার সরকার গঠন হলে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হন ছাত্রদের দুই প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলেছেন, যেটিকে রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। পরে গঠন করা হয় জাতীয় নাগরিক কমিটি।
নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, ‘আমরা জেলা, উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠন করছি। এসব কমিটিতে যারা গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সম্পৃক্ত করছি। শহিদ পরিবারের সদস্য এবং আহতরা থাকবেন এই প্রক্রিয়ায়। একই সঙ্গে ২৮ থেকে ৪০ বছর যাদের বয়স, তাদেরও সম্পৃক্ত করছি। নাগরিক কমিটি দল হবে না। এটা অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে কাজ করবে। তবে এই প্ল্যাটফর্ম কিংবা অন্য কোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে এসে তারা মিলে নতুন দল হতে পারে।’
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুটা সরকার পতনের লক্ষ্যে ছিল না। সরকার ছাত্রদের দাবি না মেনে আদালতসহ নানা পক্ষকে এখানে যুক্ত করে। আন্দোলন তীব্র হলে সরকার পতনের এক দফা দাবির সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য জোরালো দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। সরকার পতন-পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কথা চিন্তা করে আন্দোলনকারীদের একটি পক্ষ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করে, যার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণ হবে।
একই ধরনের কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরও। তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে। পরে রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে মোড় নেয়। যার কারণে এই দায়িত্বটা স্বাভাবিকভাবে এই ব্যানারের কাঁধে চলে আসে। আমাদের এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে নাগরিক কমিটির উদ্দেশ্যের মিল আছে, সেটি হলো ফ্যাসিবাদীব্যবস্থার বিলোপ সাধন করা। তবে আমাদের এই দুই (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি) প্ল্যাটফর্ম সরাসরি কোনো দলে রূপান্তরিত হবে না। যেমনটা আমরা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেখেছি। তবে বিপ্লবের পর মানুষের মনে একটা প্রত্যাশা জেগেছে। সেই প্রত্যাশা পূরণ করা যায় কি না, আমরা তা ভেবে দেখছি।’
নানামুখী সমীকরণ
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও মনে করেন, একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে তারা দেশ পরিচালনা করতে পারবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী, তাদের সমজাতীয় বিভিন্ন সংগঠনের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির জন্য। এ লক্ষ্যে জেলা, উপজেলায় কমিটি দিয়ে তারা জনসম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে ইতোমধ্যে গঠিত কমিটিতে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজন থাকায় সেখানে তৈরি হয়েছে মত-দ্বিমত। শুরুর দিকে যে গতিতে কার্যক্রম ছিল, সেটিতে এখন অনেকটা ধীরগতি।
সরকার পরিচালনার অংশ হওয়া নিয়েও নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। আবার অনেকে মনে করছেন, রাজনৈতিক দল গঠনের মোক্ষম সুযোগ তাদের হাতছাড়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী ছাত্রদের অনেক কার্যক্রম গণমানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। তখন যদি দল গঠন করা হতো, তাহলে ইতিবাচকভাবে নিত দেশের অধিকাংশ মানুষ। এখন এই সরকার ব্যর্থ হলে ছাত্রদের ওপর এর দায় আসবে। বর্তমান সরকারে ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধি আছেন। ফলে সরকারে থেকে দল গঠন করলে সবাই কীভাবে গ্রহণ করে সেটা একটা বড় বিষয়।
নাগরিক কমিটির অন্য একটি গ্রুপ মনে করছে, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে বড় একটি অংশ নতুন নেতৃত্ব চায়। তাদের কাছে বিকল্প বা যোগ্য বিকল্প নেই। যদি সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যম দল গঠন করা হয়, তাহলে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য হবে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, নতুন দল গঠন করা হলে সেটি সরকারের সঙ্গে দূরত্ব রেখে কাজ করবে। তবে অভ্যন্তরীণভাবে যোগাযোগ থাকবে।
ঢাকা মহানগরে দল গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সভা করেছেন নাগরিক কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘স্বল্প সময়ের বাস্তবতায় রাজনৈতিক দল গঠন করে মানুষের প্রত্যাশা কতটুক পূরণ করা যাবে, তা নিয়ে আমরা নিজেরাও সন্দিহান। আমাদের আলোচনা চলছে। তবে কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।’
শিবিরের আত্মপ্রকাশে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কাইয়ুম ছিলেন একজন সমন্বয়ক। দল গঠনের পরিকল্পনায় থাকাদের ধারণা ছিল, জামায়াত-শিবিরের তরুণদের একটি অংশ তাদের সঙ্গে থাকবে। তবে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের আত্মপ্রকাশের পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল থাকায় নতুন গঠিত হওয়া দল নিয়ে তাদের পরিকল্পনা নেই বলে জানা গেছে।
Sharing is caring!