প্রজন্ম ডেস্ক:
প্রায় ১৭ বছর আগে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এবারের পালাবদলের পর নির্বাসন থেকে তার দেশে ফেরার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসছে জানুয়ারিতে তারেকের দেশে ফেরার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপরই তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসে। কবে নাগাদ তিনি দেশে ফিরতে পারেন, তা নিয়েও আলোচনা আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন দলের নেতাকর্মীরাও। এর মধ্যে ভার্চুয়ালি বিএনপির সমাবেশগুলোয় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমান সরকারকে সমর্থন, তাদের সংস্কার উদ্যোগ ও বিএনপির পরিকল্পনা নিয়েও বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
তবে তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথে কাঁটা হয়ে আছে বিগত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া মামলা। এর মধ্যে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করেছে বিএনপি। অন্যদিকে আইনি পথে মামলা মোকাবিলার কথাও বলেছেন বিএনপি নেতা ও আইনজীবীরা, যাতে তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথ সুগম হয়।
তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, আগামী বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে ঢাকা ফেরার পরিকল্পনা রয়েছে তারেক রহমানের।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা দলটির এক নেতা বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে দেশে ফেরার বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন।’
তবে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির এক আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। দেশে ফিরে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করবেন।’
বিএনপির সঙ্গে রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে শরিক একটি রাজনৈতিক দলের এক শীর্ষ নেতা সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। সেখানে অবস্থানকালে তারেক রহমানের সঙ্গে তিনি দেখা করেছেন। তার সঙ্গে দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ওই নেতা বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন তারেক। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেশে ফিরবেন তিনি। সেটা আগামী জানুয়ারি মাসে হতে পারে।’
তারেকের বিরুদ্ধে যত মামলা : বিগত দুই সরকারের আমলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ৩৩টি মামলার তথ্য জানাতে পেরেছেন দলের আইনজীবীরা। এর মধ্যে এক-এগারোর সরকারের সময় হয়েছে ১৭টি মামলা। আর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়েছে ১৬টি। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা, বিভিন্ন জেলায় মানহানি মামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব মামলার সঠিক পরিসংখ্যান বিএনপি আইনজীবীদের কাছে নেই।
সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের আন্দোলনের মুখে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে।
বিএনপি নেতারা জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ৭ মার্চ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে যৌথ বাহিনী গ্রেপ্তার করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে (রিমান্ড) নেওয়া হয়। প্রায় ১৮ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে তাকে। এ সময়ের মধ্যে তারেক রহমানকে ১৩ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এসব মামলায় ধাপে ধাপে তাকে জামিন দেওয়া হয়।
২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তিনি। ৮ দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর তারেক লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই থেকে তিনি পরিবার নিয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে লন্ডনে বসেই বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
বিএনপি নেতারা জানান, এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেকের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা করা হয়। এসব মামলার মধ্যে দুর্নীতির মামলা বেশি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, অর্থ পাচার, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও ২০টির বেশি মামলা হয়েছে।
তবে বিএনপির আইনজীবীরা জানান, মানহানির অভিযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা হয়েছে। যেগুলো সম্পর্কে এখনো সেভাবে জানা যায়নি।
তারেকের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার মধ্যে এ পর্যন্ত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচার, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে করা মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সব মামলাতেই তাকে পলাতক দেখিয়ে বিচারকাজ ও সাজা দেওয়া হয়েছে।
বাকি মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ও দলটির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
আইনজীবীরা তারেক রহমানের মামলা আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করার কথা জানালেও বিএনপি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রত্যাহারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করেছে।
গত ৫ অক্টোবর অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার বাসভবন যমুনায় বিএনপির সংলাপ হয়। সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে শেখ হাসিনার শাসনামল পর্যন্ত হওয়া মিথ্যা অভিযোগের সব মামলা ও গায়েবি মামলা প্রত্যাহারের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সরকারকে বলেছি।’
বিএনপি নেতারা বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার বিষয়ে দুই রকমের মত রয়েছে। একপক্ষ চাইছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেহেতু মিথ্যা, গায়েবি, ভুয়া ও সাজানো অভিযোগে মামলা দিয়েছে এবং বিচার বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রায় দিয়েছে, তাই মামলাগুলো সরকারের নির্বাহী আদেশে প্রত্যাহার করা হোক। আবার কেউ কেউ চাইছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা মোকাবিলা করতে।
সম্প্রতি মামলাগুলোর বিষয়ে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘আইনি পথে ছাড়া অন্য কোনো পথে ফিরবেন না তারেক রহমান। তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে কারণে ওনার বিরুদ্ধে যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো তিনি আইনগতভাবে মোকাবিলা করবেন। আর যেগুলোর রায় হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে আইনগতভাবে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
যেসব মামলায় সাজা হয়েছে : অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় তারেক রহমানের ৯ বছর ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের তিন বছরের সাজা হয়েছে। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এই কারাদন্ডাদেশ দেন। তারেক রহমানকে দুই ধারায় তিন ও ছয় বছর করে সাজার রায় দেওয়া হয়। এই সাজা একসঙ্গে চলবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তাকে তিন কোটি টাকা অর্থদন্ড, অনাদায়ে আরও তিন মাস সাজাভোগ করতে হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেয়। ওই মামলায় তারেকের বন্ধু ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে খালাস দেওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে দুদক। আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতের দেওয়া খালাসের রায় বাতিল করে তাকে সাত বছরের কারাদন্ড দেয়। পাশাপাশি তারেককে ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেন ঢাকার ৫ নম্বর অস্থায়ী বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেয় আদালত। বিচারিক আদালত খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদন্ড দিলেও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে উচ্চ আদালত কারাদন্ড দ্বিগুণ করে দশ বছর করে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা মামলায় তারেককে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর অস্থায়ী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন এ রায় ঘোষণা করেন।
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে আয়োজিত এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নানা মন্তব্য করেন তারেক রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে নড়াইলে একজন মুক্তিযোদ্ধার করা মানহানি মামলায় ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদন্ড দেয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২। একই সঙ্গে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়।
৫ আগস্টের পর দুই মামলা প্রত্যাহার : ২০১৪ সালের ১৫ ও ১৭ ডিসেম্বর তারেক রহমান লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ এনে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা করা হয়। এর মধ্যে গত ১ অক্টোবর নোয়াখালীতে হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জামিন পান তিনি। গত ২৫ আগস্ট আরেকটি মামলা প্রত্যাহার করেন দিনাজপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক পারভেজ আহম্মেদ চৌধুরী। ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক বাবুল আকতার মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
Sharing is caring!