প্রজন্ম ডেস্ক:
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চরম বিশৃঙ্খলায় স্থবিরতা নামে প্রশাসনে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে প্রশাসনকে গতিশীল করার চ্যালেঞ্জে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে কেটে গেছে দুই মাস। কিছু নতুন সিদ্ধান্ত নিলেও প্রশাসন এগোচ্ছে কচ্ছপগতিতে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সরকারের সময়ে ‘বঞ্চিত’ দাবি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একযোগে আন্দোলন শুরু করেন। তড়িঘড়ি করে বঞ্চিতদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে গিয়ে আসছে ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত । সৃষ্টি হচ্ছে বিতর্কের।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগী কর্মকর্তাদের সরাতে হচ্ছে এ সরকারকে। যেখানে নিয়োগ দিচ্ছে যোগ্য কর্মকর্তাদের। এক্ষেত্রে নানান তথ্যগত ত্রুটি ও কারও কারও অসাধু তৎপরতায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সেগুলো পরে সংশোধন করেও নিতে হচ্ছে।
এছাড়া নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে সবাই প্রায় নতুন। তাদের বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগছে। কেউ কেউ তাদের ভুল বুঝিয়ে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা মনে করেন, নানান চ্যালেঞ্জ থাকায় দুই মাসে প্রশাসন কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারেনি। এখনো শৃঙ্খলা পুরোপুরি ফেরানো যায়নি। গতিও ধীর। তবে পরিস্থিতি হতাশাজনক এটাও বলতে নারাজ তারা। কারণ প্রশাসনকে একটা ভালো জায়গায় নিতে এ সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ওইদিনই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। পরদিন ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর গত ৮ আগস্ট শপথ নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেত্বত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নিয়োগ পান ১৬ জন উপদেষ্টা। পরে আরও চারজন উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারে যুক্ত হন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিজের কাছে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টার অধীনে। সাতজন ছাড়া বাকি উপদেষ্টারা একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সামলাচ্ছেন।
দুই মাসের মূল্যায়ন জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘এ মুহূর্তে বলার অবস্থা নেই। সময় আসুক জানাবো।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ-সাবেক আমলাদের মূল্যায়ন
সরকারের দুই মাস নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলছেন, যে পরিস্থিতিতে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেই অবস্থা থেকে প্রশাসনকে একটা স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুই মাস খুবই অল্প সময়। দাবি-দাওয়া, আন্দোলন তাদের অনেকটাই নাজেহাল করেছে। প্রশাসনের পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক নয়, গতিও ধীর।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘দুই মাসে সরকারের নেতৃত্বের জায়গা থেকে যতটা গতি আশা করেছিলাম ততটা আসেনি, গতি কিছুটা শ্লথ। জনগণ মনে করছে, তারা সরকারের কাছে আশানুরূপ গতিটা পাচ্ছে না।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘দুই মাস কিন্তু খুব অল্প সময়। দায়িত্ব নেওয়ার পর এ সরকার অস্বাভাবিক অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের সবকিছু বুঝতেও তো একটু সময় লাগে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের পতনের পর এত দাবি-দাওয়া, অতীতে কখনও একসঙ্গে আসেনি। যৌক্তিক দাবিও আছে। তবে অযৌক্তিক দাবিই বেশি। এটা তাদের নাজেহাল করেছে। এর মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার যেটুকু করেছে, সেটা মোটামুটি সন্তোষজনক। পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়, আবার হতাশাজনকও নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম বলেন, ‘প্রশাসনের এখন যে অবস্থা, সেটা থেকে বলা যায় আমাদের প্রত্যাশা থেকে বেশ দূরেই আছে। মোটামুটি সন্তোষজনক বলা যায়, একদম ভালো সেটা বলা যাবে না। বিভিন্ন পক্ষের নানা দাবি-দাওয়া আদায়ের যে আন্দোলন, সেটা এখনো আছে।’
তিনি বলেন, ‘স্তরে স্তরে গত সরকারের লোকজন নিয়োগ পেয়েছিল। ব্লাডগ্রুপ দেখে দেখে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে সমস্যা হচ্ছে কী, আপনি যখন এ জঞ্জাল সরানোর চেষ্টা করবেন, পরের স্তরের লোকজনও কিন্তু গত সরকারের আমলের রিক্রুটেড। তাই তাদের চ্যালেঞ্জের লেভেলটা অনেক উঁচু। সবাইকে তো বাদ দেওয়া যাবে না। কাউকে না কাউকে নিয়ে তো সরকারকে চলতে হবে।’
‘সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষটি বসানো, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অবজেক্টটিবলি অ্যাসেসমেন্ট করবো? অনেক সময় ভুল তথ্যের কারণে ভুল লোক নির্বাচন করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’ বলেন মোবাশ্বের মোনেম।
তিনি বলেন, ‘আমি এ সরকারকে দশে ৭ বা সাড়ে ৭ দেবো। তাদের চেষ্টা আছে। চেষ্টা থাকলে ওনারা বুঝবেন যে প্রশাসনটা আরও কীভাবে গুছিয়ে আনতে হবে।’
পদোন্নতি-পদায়ন-বদলি ও বিতর্ক
দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দুই মাসে ‘বঞ্চিত’ হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হচ্ছে, পাঠানো হচ্ছে বাধ্যতামূলক অবসরে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে শতাধিক কর্মকর্তার। ওএসডিও করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে।
আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি ও পদায়ন করতে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে। অনিয়মে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়েছেন। বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সচিব কিংবা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে, যা সমালোচনার সৃষ্টি করে। এজন্য ভুলগুলো শুধরে বারবার সিদ্ধান্ত বদলাতে দেখা যাচ্ছে। অনভিজ্ঞতা এ সরকারের বড় দুর্বলতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সচিবসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের বিষয়টি এখনো চলমান। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া খাদ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে খাদ্য সচিব নিয়োগ দেওয়ার একদিন পর তা বাতিল করা হয়। একজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে নৌ-সচিব নিয়োগ দেওয়ার দু’দিন পর তাকে ওএসডি করা হয়। যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ না দেওয়ার কারণে এভাবে সিদ্ধান্ত বদলাতে হচ্ছে বারবার।
সুযোগ বুঝে অনেকেই অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া তুলেছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সেগুলো মোকাবিলা করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে জনপ্রশাসনকে।
ডিসি নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা হাতাহাতিতেও জড়ান। তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান জানান, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা করায় ১৭ জন উপসচিবকে শাস্তির সুপারিশ করেছে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি।
এছাড়া ডিসি নিয়োগ কেন্দ্র করে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়েছে অভিযোগ করে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তা ‘মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনে সাবেক অর্থসচিব ও বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী জাকির আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। এ কমিটির কাছে আবেদন করেছেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা।
কিছু নতুন উদ্যোগ
এই অল্প সময়ের মধ্যে প্রশাসনকেন্দ্রিক নতুন কিছু উদ্যোগও নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে জানিয়েছে, দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দিতে হবে সম্পদের হিসাব। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হবে। তবে এ বছর ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা দাখিল করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উপদেষ্টাদেরও সম্পদের হিসাব দিতে হবে। এজন্য একটি নীতিমালাও করা হয়েছে।
এছাড়া প্রশাসন সংস্কারে সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মূয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনও শিগগির কাজ শুরু করবে। একই সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য মূয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স যে বাড়ছে এটি মোটামুটি নিশ্চিত।
Sharing is caring!