প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

গুজব গুঞ্জনের নেপথ্যে

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ১০, ২০২৪, ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ
গুজব গুঞ্জনের নেপথ্যে

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা গুজব-গুঞ্জনের ছড়াছড়ি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভুয়া ও অপ-তথ্য ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দলীয় ফেসবুক পেজ থেকেও গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আসছে।

 

যথেষ্ট পরিমাণ সাইবার নজরদারি না থাকায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় গুজবকারীরা এটা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছে। বিনিময়ে ভিউ ব্যবসা করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে এবং তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে ফায়দা নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও কখনো নিজেরা আবার কখনো টাকা খরচ করে বিভিন্ন ইস্যুতে গুজব রটাচ্ছে। আবার এসব গুজব তারা নিজেরাই শেয়ার করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, গুজব নিয়ে সাইবার ইউনিটগুলো কাজ করছে। সাইবার পেট্রোলিং, নজরদারি করে অনেক পেজ, আইডি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব প্ল্যাটফরম থেকে গুজব ছড়ানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হচ্ছে।

 

শুরুটা হয়েছিল সরকার পতনের পর দেশব্যাপী পুলিশের অনুপস্থিতে চুরি ডাকাতি ও মন্দির ভাঙচুর নিয়ে। তখন প্রায়ই ফেসবুকে ভেসে বেড়াতো ডাকাতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাগুলো। বিশেষকরে মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কয়েক বছর আগের পুরাতন ছবি ছড়িয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। গুজব ছড়িয়ে একটি পক্ষ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আন্দোলনে নামাতে বাধ্য করে। যদিও পরে তারা বুঝতে পারেন এটি গুজব। তবে বিচ্ছিন্ন পরিসরে কিছু ঘটনাও ঘটেছিল। সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সোচ্চার হওয়ার পরে গুজব বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বন্যার সময়ও বিভিন্ন পেজ থেকে গুজব ছড়ানো হয়। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রতিমা ভাঙচুরের গুজবও ছড়ানো হয়।

 

উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে তাকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়। শেখ হাসিনা পরিবারকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও সোহেল তাজ। এমন গুজবে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৯৪ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ হাসিনাকে বৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন এমন গুজবও কিছুদিন আগে ছড়িয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। হাসিনা শিগগিরই দেশে ফিরবেন বলে এখনো গুজব ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পলায়নের আগে থেকেই গুজবের বাহনে হাঁটছে দলটি। দলটির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে একের পর এক গুজব। নানান সময় গুজব ছড়িয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে অস্থিরতা। এই গুজবগুলো ছড়ানো হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের গ্রুপ ও পেজ থেকে। গুজব ও অসত্য তথ্য যাচাইকারী সংশ্লিষ্ট পেজ ‘রিউমার স্ক্যানার’ বলছে- শুধু আগস্ট মাসেই ৩৭০টি গুজব যাচাই করেছেন তারা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। গত ৪ঠা আগস্ট ছাত্র-জনতার বিশাল জমায়েত থেকে আওয়ামী সরকারের পতনের একদফা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পরই জানানো হয় একদিন এগিয়ে এনে পরদিনই হবে রোডমার্চ টু ঢাকা। এদিন রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হয়। তারকাদের ছবি ব্যবহার করে ‘কোটা সংস্কারের পক্ষে ছিলাম, কিন্তু একদফার পক্ষে নাই’। আবার এদিন রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে ব্যাপক প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়। রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ দখলে নিয়েছে ছাত্রলীগ এমন প্রচারণা চালানো হয়। অথচ তেমন কোনো কিছুই ছিল না সে রাতে। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছিল সুনসান নীরবতা।

 

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে ভিডিও ছড়িয়ে বলা হয়- অন্তর্বর্তী সরকারের বিপক্ষে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ মানুষ। পরবর্তীতে জানা যায় এগুলো ছিল পুরনো দিনের ভিডিও। এরপরই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়- সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ করা হচ্ছে নির্বিচারে। এসবে ব্যবহৃত ছবি ব্যবহার করা হয় পুরনো। আবার শাহবাগে বিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন করেন। কিন্তু এরপর ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে কোথায় হামলা হয়েছে এটা বলা হলে তারা ‘নিজ বাড়ির’ ঠিকানা পর্যন্ত বলতে পারেননি। এর পরপরই ফের একটি গুজব ছড়ানো হয় এদেশে পূজা উদ্‌যাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপর শুরু হয় জাতীয় সংগীত নিয়ে গুজব। এরপর ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় জাতীয় সংগীতের বদলে পাঠ করা হবে সুরা ফাতিহা।

 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার দুটি আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়। এটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপে। তবে পরবর্তীতে এটা যে ইডিট ছবি তা জানা যায়। কয়েকটি নকল পদত্যাগপত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে বলা হয়- পদত্যাগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। এরপর মামুনুল হকের ছবি ব্যবহার করে বলা হয়- হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আবার ব্যাপকভাবে প্রথম আলোর লোগো ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল- বদলে গেল পুলিশের লোগো। নৌকা বাদ দিয়ে আল্লাহু। আবার ভারতীয় মিডিয়ায় অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধনের ভিডিও ছড়িয়ে বলা হয়- হিন্দু নারীর কান্না। ভারতীয় মিডিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাসভবন যমুনার সামনে নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে রাস্তায় বসে পড়া নারীদের ছবি ব্যবহার করে পরিচয় দেয়া হয়- বাসস্থানে হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন। ভারতীয় মিডিয়ায় এরকম অসংখ্য ঘটনাকে হিন্দুু নির্যাতন বলে চালানো হয়।
এলিটফোর্স র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, র‌্যাবের সাইবার ক্রাইম ইউনিট থেকে সাইবার পেট্রোলিং করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদ আলম বলেন, সবসময়ই একটা পক্ষ গুজব ছড়িয়ে অস্থির পরিবেশ তৈরি করতে চায়। আমরা যারা সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করি তারা সাইবার পেট্রোলিং, নজরদারি করে থাকি। যেগুলো প্রপাগান্ডা সেগুলো শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, দুর্গাপূজাকে ঘিরে বিভিন্ন স্থান থেকে গুজব ছড়ানো হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো দুয়েকটা ঘটনা ঘটেছে তবে সেটাকে বড় করে গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি পক্ষ। এগুলো নিয়েও আমরা কাজ করেছি এবং এখনো করছি।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, একটা দেশে গুজব রটনাকারীরা গুজব ছড়ানোর সুযোগ তখনই পায় যখন বিষয়গুলো বিশ্বাস করার মতো লোক থাকে। আমাদের এখানে গুজব বিশ্বাস করার লোক সবসময়ই আছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যারা বিরোধী অবস্থানে থাকে বা যারা সরকারে থাকেন তাদের সমর্থকগোষ্ঠী অথবা নিজেদের অর্থায়নে তৈরি সমর্থকগোষ্ঠী নানাভাবে মানুষকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে। বিভ্রান্ত করলে লাভ হলো যারা সরকারে থাকে তারা ভুল তথ্য ছড়িয়ে বিরোধীপক্ষে যারা তাকে তাদের সম্পর্কে যদি একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা যায় তবে তারা মনে করে এটা রাজনৈতিক সফলতা। একইভাবে বিরোধী অবস্থানে যারা থাকে তারাও এরকম করে।

Sharing is caring!