প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

করোনা-আন্দোলেনে শিক্ষায় অপূরণীয় ক্ষতি

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৩, ২০২৪, ০৭:৩১ পূর্বাহ্ণ
করোনা-আন্দোলেনে শিক্ষায় অপূরণীয় ক্ষতি

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

নানা কারণে দেশে শিক্ষায় ধাক্কা লাগছে প্রতিনিয়ত। কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবার কখনো মানবসৃষ্ট কারণে অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায়। ২০২০ সালে মহামারি করোনায় ব্যাহত হয় প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়ালেখা। ধাপে ধাপে এ অচলাবস্থা কাটানোর চেষ্টা হলেও কোভিডের ক্ষতিকর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। করোনার মতো ব্যাপক প্রভাব না পড়লেও ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনের কারণে শিক্ষায় ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মনোজগতে পরিবর্তন, পাঠ্যসূচিতে সংযোজন-বিয়োজন, পরীক্ষা না দেওয়ার প্রবণতা, উচ্চশিক্ষায় সেশনজট, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাবলিক পরীক্ষা, অটোপাসসহ নানা কারণে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ মার্চ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংক্রমণ বাড়লে পর্যায়ক্রমে বাড়ে ছুটিও। সব মিলিয়ে দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ থাকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ জানায়, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মৌলিক সাক্ষরতা এবং গাণিতিক দক্ষতার ঘাটতি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। বিশ্লেষকদের মতে, মহামারির বহুমাত্রিক প্রভাবের মধ্যে শিখন ঘাটতি এবং শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার উচ্চহার ছিল ব্যাপক। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের (বিইডিইউ) সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়, ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি ও ৬৯ শতাংশ গণিতে প্রত্যাশিত দক্ষতার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গবেষণায়ও তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে একই ধরনের তথ্য উঠে আসে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রকাশনা এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩-এর তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ (দ্বিতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে) এবং ৬ শতাংশ (ষষ্ঠ শ্রেণির ক্ষেত্রে) শিক্ষার্থী পরবর্তী বছর বিদ্যালয়ে যায়নি অর্থাৎ তারা ঝরে পড়েছে। এমনকি এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের ৫৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরতে চায় না। পাশাপাশি সংকটের সময় অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ডিভাইস না থাকার কারণে পিছিয়ে পড়ে।

সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগ থাকলেও করোনার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে চট্টগ্রামের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার জীবনে করোনার ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। আমি যখন বিদ্যালয়ে যোগ দিই, তখন দেখতে পাই শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম। করোনায় যারা স্কুল ছেড়েছে, তারা ফেরেনি। অনেকে আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে পারেনি।’

ঝরে পড়ার পাশাপাশি সেশনজটের কবলে পড়ে শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়েছে অনেকের। ফলে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় তারা অংশ নিতে পারেননি। চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩০ বছর নির্ধারিত থাকায় তাদের আবেদনের সুযোগও কমে আসে। যদিও সম্প্রতি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগও কমে যায়। কর্মসংস্থানের অভাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বেড়ে যায়।

অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনের কারণেও প্রায় এক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নির্ধারিত পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। একই শিক্ষাবর্ষের হয়েও সবাই একই সঙ্গে অনার্স কিংবা মাস্টার্সের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। আবার অনেকের ফলও প্রকাশ হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের অনেক বিভাগের শিক্ষার্থী সম্প্রতি ঘোষিত ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করতে পারবেন না। আবার একই বর্ষের অনেক শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় তারা আবেদন করতে পারবেন। গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুল হক আবেদনের সময় জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।

এই আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের মনোজগতেও পরিবর্তন আসছে। নানা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় একটা অংশের মধ্যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। আবার অনেকে সহপাঠীকে হারিয়ে চরমভাবে ভেঙে পড়েন। অনেককে আন্দোলনে প্রাণ হারানো সহপাঠীর ছবির সঙ্গে ফুলের তোড়া রেখে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিতেও দেখা গেছে। আবার আন্দোলন-পরবর্তী শিক্ষার্থীদের আচরণ নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের সহিংস হতে দেখা গেছে। হঠাৎ করেই নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন তারা। পরীক্ষা বাতিল এবং ফল পরিবর্তনের দাবিতে ফেল করা শিক্ষার্থীরাও সচিবালয়ের মতো জায়গায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের মতো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হেনস্তার ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে দাবি করে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে চালানো হয় ব্যাপক ভাঙচুর। নানা জটিলতায় পড়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের হাজারও শিক্ষার্থী।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নেতিবাচক কর্মকাণ্ড যারা করছেন এই সংখ্যাটা বেশি নয়। এখানে কারও হয়তো ইন্ধনও থাকতে পারে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনো-সামাজিক কাউন্সিলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

 

অটোপাসের ডামাডোল, পরীক্ষা না দেওয়ার প্রবণতা

করোনার কারণে ২০২০ সালের এইচএসসির পরীক্ষার্থীরা অটোপাসের মাধ্যমে ফলাফল পায়। পরবর্তী বছর কম বিষয় ও কম নম্বরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালেও কম নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২০২৩ সালেও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ণ বিষয় ও নম্বরে পরীক্ষা না দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ঘাটতি তৈরি হয়। চলতি বছরও বন্যার কারণে সিলেট বিভাগে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দুর্গত জেলাগুলোর শিক্ষা খাতে দেখা দিয়েছে বিপর্যস্ত অবস্থা। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় শিক্ষা খাতে দেখা দেয় বিপর্যস্ত অবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে ভবন ও আসবাব ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক দিন পাঠদান করা সম্ভব হয়নি।

পরবর্তী সময়ে জুলাই আন্দোলনের কারণে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরীক্ষা বাতিল চেয়ে সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে একদল পরীক্ষার্থী। পরে পরীক্ষা বাতিল করে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফল প্রকাশ করা হয়।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কারিকুলাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভাগ বিভাজন চালু করা হবে বলে জানানো হয়। এ ছাড়া ২০২৪ সালে নবম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য দশম শ্রেণিতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস চালুর কথা উল্লেখ করা হয়। বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একটি অংশ সমালোচনা করছেন। তাদের দাবি, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন দরকার।

Sharing is caring!