প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশে নৃশংস খুন-জখমের ঘটনা ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। তুচ্ছ কারণেও মানুষ হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক কলহের জেরেও এখন অহরহ খুনের ঘটনা ঘটছে। এসব নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অপরাধ ঘটালেও কিছুই হবে না’ এমন চিন্তা ও ধারণা থেকেই অপরাধীরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি মাসে গত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত কেবল রাজধানীতে অন্তত ৮ জন খুন হয়েছেন। এসব খুনের অধিকাংশই ঘটেছে সামাজিক-পারিবারিক কলহ বা শত্রুতার জেরে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগস্ট (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছাড়া) থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে কেবল রাজধানীতে খুন হন ৮৫ জন। সে হিসাবে গত সাড়ে তিন মাসে মোট খুনের সংখ্যা ৯৩ জন। এর মধ্যে গত আগস্টে ১৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৪১ জন, অক্টোবর মাসে ২৭ জন ও নভেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত ৮ জন খুন হয়েছেন। প্রতিটি খুনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীতে সেপ্টেম্বরে শুধু ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ২০টি এবং অক্টোবরে ২১টি। এ ছাড়া মানবাধিকার সংস্থা আসকের তথ্যমতে, গত তিন মাসে (আগস্ট-অক্টোবর) ৮৬ শিশু খুন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, রাজধানীতে খুনের ঘটনা বেড়েছে এটা বলা যায় না। বরং এমন ঘটনার হার নিম্নমুখী। যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো অধিকাংশ পারিবারিক বা সামাজিক কলহের জেরে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ ঘটনা তদন্ত করে রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করাও হয়েছে। ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের সব কটি ইউনিট স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছে। অচিরেই সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে।
একই প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেছেন, পেশাদার অপরাধীদের গ্রেপ্তারে র্যাব নিয়মিত অভিযান ও টহল পরিচালনা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সারা দেশে র্যাবের সব কটি ব্যাটালিয়নকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. এ বি এম নাজমুস সাকিব বলেন, যেকোনো ধরনের (রাষ্ট্রীয়) পরিবর্তনের পর মানুষের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতা কাজ করে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও আইন প্রয়োগের বিষয়গুলো শিথিল হয়ে পড়ে। তারা কী করবে, কোনভাবে এগোবে সে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারে না। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সঠিক বা যথাযথ দিকনির্দেশনাও তারা পায় না তারা। বর্তমানে সে রকম অবস্থাই বিরাজ করছে। আর এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। তারা ভয়ানক অপরাধ ঘটাতেও দ্বিধাবোধ করছে না। তার মতে, ‘অপরাধ করলেও সমস্যা হবে না’ এমন চিন্তা যখন মাথায় থাকে তখনই সাধারণত অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, অপরাধীরা যখন মনে করে, ‘যাই করি না কেন কিছুই হবে না, বিপদে পড়ব না’ তখনই তারা ভয়ানক অপরাধগুলো ঘটিয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো পদক্ষেপের ঘাটতি থাকলেই মূলত অপরাধীরা ওই জাতীয় অপকর্ম ঘটানোর সুযোগ পায়। এ ছাড়া মাদক সেবন, নৈতিক অবক্ষয়, পরকীয়া, সাইবার দুনিয়ার প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলা থেকে নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। যার প্রধান শিকার হচ্ছে শিশুরা।
পরিস্থিতির উন্নতি কীভাবে সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে ড. তৌহিদুল হক বলেন, এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাই মুখ্য। তারপর সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে নাগরিকদেরও সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ অপরাধীরা এখন তাদের অপরাধের কৌশল পাল্টেছে। বর্তমানে টার্গেট করে সম্পর্ক গড়ে ভয়ানক অপরাধ ঘটানোর প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। তাই অপরিচিতদের কাউকে দ্রুত বিশ্বাস না করে বরং ভালোভাবে যাচাই করে আস্থায় নিতে হবে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা পুলিশের প্রধান কাজ। সে হিসেবে তাদের অপরাধপ্রবণ এলাকা ও অপরাধের ধরন চিহ্নিত করে সেদিকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। যেখানে নিরাপত্তার ঘাটতি আছে, সেখানে বাড়াতে হবে নিরাপত্তাব্যবস্থা। প্রয়োজনে অন্য ইউনিট বা এলাকা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স এনে অপরাধপ্রবণ এলাকায় মোতায়েন করতে হবে। এ ছাড়া পেশাদার অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা গেলেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নয়ন সম্ভব।
মানবাধিকার সংস্থার তথ্য যা বলছে
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুসারে গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩৫ জন খুন হয়েছেন। এ সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৮ জন। এ ছাড়া এই তিন মাসে ৮৬ শিশু খুন হয়েছে। শিশু খুনের ঘটনার মধ্যে আগস্টে ১৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৪২ এবং অক্টোবরে ২৮ জন। এ ছাড়া চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৫৮০ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে সারা দেশে ৪৩১ শিশু হত্যার শিকার হয়।
এ ছাড়া মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এবং ‘আসক’ জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে নিহত হয়েছেন ১১ জন। এ দুই মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩১ জন। আর রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৫২ জন।
গত ১৬ দিনে রাজধানীতে ৮ খুন
খবরের কাগজের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১ নভেম্বর রাতে রাজধানীর চকবাজারে পূর্বশত্রুতার জেরে আটতলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে মো. জীবন (১৮) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের পরিচিত লতিফ নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। একই দিনে রাজধানীর সবুজবাগের বাসাবো এলাকা থেকে (নিখোঁজের এক দিন পর) গাড়িচালক সোহেল মিয়ার (৪৮) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার মাথার বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল। এরপর গত ৯ নভেম্বর রামপুরা চৌধুরীপাড়ার একটি বাসার কক্ষ থেকে জুবায়ের হোসেন বিপুল (২৭) ও মাইসা আক্তার (১৮) নামে স্বামী-স্ত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পারিবারিক কলহের জেরে বিপুল তার স্ত্রীকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় পুলিশ। গত ১১ নভেম্বর তুরাগ এলাকায় ছেলের ছুরিকাঘাতে মা দিনু বেগম (৪০) খুন হন। নিহতের ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন বলে স্থানীয়রা জানান। গত ১৫ নভেম্বর হাজারীবাগে সাইকেল চোরকে ধরতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে খুন হয় শাহাদত হোসেন আকবর ওরফে শান্ত (১৭) নামে এক কিশোর। এ ছাড়া গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর পল্লবীতে দুই শিশু সন্তান রেহান (৭) ও মুসাকে (৩) গলা কেটে করে হত্যার পর নিজেও একইভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মো. আহাদ মিয়া (৪০)।
এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে সিলেটের কানাইঘাটের জনৈক শামীম আহমদের ৬ বছরের মেয়ে মুনতাহা আক্তার জেরিন। নিখোঁজ হওয়ার সাত দিন পর ১০ নভেম্বর মুনতাহার লাশ উদ্ধার করা হয়। ছোট্ট এ শিশুটির লাশ পুকুরের কাদামাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মুনতাহার সাবেক গৃহশিক্ষক শামীমা বেগম মার্জিয়াসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া গত ১০ নভেম্বর বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় বাড়ির ডিপ ফ্রিজ থেকে এক নারীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়।
Sharing is caring!