প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর তিন দিনের মাথায় ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই সরকারের আজ ১০০তম দিন। যেকোনো সরকারের প্রথম ১০০ দিন বেশ গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়। সাধারণত এই সময়কে সরকারের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বলা হয়। পরিবর্তিত বিশেষ প্রেক্ষাপটে এই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ১০০ দিন ছিল খানিকটা ব্যতিক্রম। যেকোনো নির্বাচিত সরকারের ১০০ দিন আর এই সরকারের ১০০ দিন এক নয়।
শুরু থেকেই জটিল পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে এই সরকারকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভেঙে পড়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় পার করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই কর্মকাণ্ডকে ঘিরে জনমনে ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। জনগণ মনে করছে, রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে এবং এবং দল-মতনির্বিশেষে দেশের ভেঙে পড়া অবকাঠোমো বিনির্মাণে একমাত্র ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সরকারই সফল হবে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম এক মাস এই সরকারকে সংক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ধারাবাহিক বিক্ষোভ-সমাবেশ, আন্দোলন-সংগ্রাম ও কর্মসূচির মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিগত সরকারের ১৫ বছরে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীও ছিল মাঠে। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যরা কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বহুল আলোচিত আয়নাঘরের বিলুপ্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নানা পদক্ষেপ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম বা গুপ্তহত্যা নিরসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
এ ছাড়া প্রশাসন ও বিচার বিভাগ থেকে দুর্নীতিগ্রস্তদের অপসারণ, বৈদেশিক নীতির পর্যালোচনা ও সময়োপযোগীকরণ, অপরাধ-দুর্নীতিবিষয়ক একটি অনুসন্ধানী শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে লুটপাট এবং অর্থ পাচারকারীদের তদন্তের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করা সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ। পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটাতে উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা জোরদার করা এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফেরানোর উদ্যোগ গত ৫০ বছরের ইতিহাসে জনমনে আশাবাদ তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে। এসব কাজে ত্রুটি-বিচ্যুতি যে একেবারে নেই, তা নয়। তবে সরকারের নিরলস চেষ্টা স্পষ্টতই জনগণের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
এ সময়ে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পদক্ষেপ হলো ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ’ শুরু করা। এ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য সব দলই। প্রতিটি রাজনৈতিক সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের কাছে নির্বাচনের একটি ‘রোডম্যাপ’ চাওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রয়োজনীয় সময় দিতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো পৃথক বিবৃতিও রয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে রাজি হয়েছে।
গত ৮ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পূর্তিতে ৫৩টি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের অগ্রগতির বিবরণ ঘোষণাকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তিন মাসে সরকার পাঁচটি বড় কাজ করেছে। এক. স্মুথ ট্রানজিশন (শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন)। দুই. একটি ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতি উদ্ধার, তিন. ব্যাপক বৈশ্বিক সহায়তা অর্জন, চার. সংস্কারের পথরেখা দেওয়া। সংস্কারের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ হবে, তখন সংস্কার কতটুকু করা হবে এবং সেটার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের তারিখ। পাঁচ. এই তিন মাসে বন্যা, পোশাকশিল্পে অস্থিরতাসহ অনেকগুলো সমস্যা ছিল। সেসব সমস্যা থেকে দেশকে উত্তরণের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রেস সচিব বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সমস্যাগুলো কতটা ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়।’
সহিংসতায় অচল মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন মেরামত ও দ্রুততার সঙ্গে তা চালু করতে সফলতা দেখিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। হজের ব্যয় কমিয়ে আনার ঘটনা জনমনে স্বস্তি তৈরি করেছে। দেশের মানুষ এ ঘটনাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দেখছে। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে পুরোপুরি সন্তুষ্টি নেই। সরকার অবশ্য এ দুটি বিষয় সামাল দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
দেশের অর্থনীতি সচল করতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ অন্য বিদেশি উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সরাসরি ও কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদারে এবং বিভিন্ন খাতের সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছে এ সরকার। এরই মধ্যে সরকারকে আনসারদের একাংশের বিদ্রোহ ও সচিবালয় ঘেরাও, জনরোষে সৃষ্ট মব জাস্টিস এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ ছাড়া নতুন সরকারের কাছে একের পর এক দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিক্ষোভ-সমাবেশ, চাকরি জাতীয়করণের দাবি এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান চেয়ে সমবেত হওয়া আপনজনদের তৎপরতা সামলানোর ঘটনা গত ১০০ দিনে ছিল উল্লেখ করার মতো।
গত জুলাই ও আগস্টের আন্দোলনে পুলিশ ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকর্মীদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে আমন্ত্রণ, শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি, সেই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুত কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নে সফলতা দিখিয়েছে।
এ ছাড়া আগের সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারকে অপসারণ করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুরকে গভর্নর নিয়োগ এবং ব্যাংকে বড় ঋণখেলাপিদের শনাক্ত করার মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা নেওয়া ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখলমুক্ত করতে নয়টি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠনের মতো আলোচিত উদ্যোগও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। অর্থ পাচার ও সীমাহীন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রভাবশালী ১৫০ ব্যক্তির তালিকা তৈরি এবং ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু ছাড়াও আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত সম্পদ অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল, কুইক রেন্টাল দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা, গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার মতো সিদ্ধান্তসমূহ সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে গোপনে ভারতে চলে যান। এর পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট। এ সময়ে আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। দলীয় নেতা ও সরকারঘনিষ্ঠ আমলারাও গা-ঢাকা দিয়েছেন। এদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দেন রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন করা হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া ব্যাংক সংস্কারে ছয়টি টাস্কফোর্স এবং গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি সংস্কার কমিশন ও টাস্কফোর্স নিজ নিজ কাজ শুরু করে দিয়েছে।
Sharing is caring!