প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

দেশে বেড়েছে চায়ের উৎপাদন, রপ্তানিতে নেই সুখবর

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১১, ২০২৪, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ
দেশে বেড়েছে চায়ের উৎপাদন, রপ্তানিতে নেই সুখবর

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বাংলাদেশে চা শিল্পের ইতিহাস প্রায় পৌনে দুইশ বছরের। একসময় পাটের পর চা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য। স্বাধীনতার পর চায়ের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও রপ্তানিতে নেই কোনো ধারাবাহিকতা। গত এক দশকে বরং আরও কমেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়া, রপ্তানিযোগ্য উন্নত প্রজাতির চা উৎপাদন না হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দামের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় দিন দিন বাংলাদেশের চা রপ্তানি কমছে।

 

শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা, উৎপাদনকারীদের জন্য চা আইন সহজ করা, আর্থিক সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করা ও শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

 

বর্তমান পরিস্থিতি

 

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে চা উৎপাদন ছিল তিন কোটি কেজি, যা বর্তমানে ১০ দশমিক ৩ কোটি কেজিতে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০ দশমিক ৮ কোটি কেজি। আগস্ট মাস পর্যন্ত চা উৎপাদন হয়েছে ৪ দশমিক ৯ কোটি কেজি।

 

 

বাংলাদেশের চা শিল্পের দেশীয় চাহিদা ৯ দশমিক ৫ কোটি কেজি। অর্থাৎ, চাহিদার বেশি চা উৎপাদন হচ্ছে। ফলে দাম কমে যাচ্ছে এবং ব্যবসায়ীরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

 

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে দেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান ও টি-এস্টেট আছে। তবে এর মধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১২৯টি বাগান ও টি-এস্টেট। বাংলাদেশে দুই লাখ ৮০ হাজার একর জমির নিবন্ধিত বাগানে চা চাষ করা হচ্ছে।

গত ৫৩ বছরে চা শিল্পে অনেক উন্নয়ন হলেও পাঁচ বছর ধরে চায়ের দাম নিম্নমুখী। বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, ‘চা শিল্পের মূল সমস্যা কম মূল্য। আমরা কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। গত পাঁচ বছর ধরে দাম নিম্নমুখী। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করছি। ২০২২ সালে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দীর্ঘ ১৯ দিন পুরো শিল্প বন্ধ ছিল। ফলে প্রায় ৪শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল, যা এখনো আমরা পুষিয়ে উঠতে পারিনি।’

কামরান বলেন, ‘তখন শ্রমিকদের মজুরি প্রায় ৪২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করা হয়েছিল। সবাই শুধু অর্থ দিয়ে পরিমাপ করে। চা-শ্রমিকদের বেতনের পাশাপাশি আরও অনেক সুবিধা দেওয়া হয়, তা নিয়ে কেউ কথা বলে না। চা শিল্পে বেতনও দেওয়া হয় ‘ইন ক্যাশ অ্যান্ড ইন কাইন্ড’ হিসেবে। চা শ্রমিকরাও এটাই চায়।’

সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের ১২টি বাগান লোকসান গুনতে গুনতে বন্ধ হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

 

 

রপ্তানির অবস্থা

 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ দশমিক ৮ কোটি কেজি চা রপ্তানি হয়। মূলত ভারত, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, পাকিস্তান, কুয়েত, ব্রুনাই, ওমান, সাইপ্রাসে রপ্তানি হয়েছে এসব চা। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি চা রপ্তানি হয়েছে ভারতে, যার পরিমাণ ২০০ কেজি। এর পরই আছে সংযুক্ত আরব-আমিরাত, যেখানে ১৬৮ কেজি চা রপ্তানি হয়েছে।

গত ২৪ অক্টোবর চা আইন, ২০১৬ এর ধারা ১৯ ও ২১ এর অধীন ক্ষমতাবলে দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোং (বাংলাদেশ) লি-কে ৯ হাজার ৭১৫ কেজি গ্রিন টি বালিশিরা চা বাগান থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে সরাসরি পাকিস্তানে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। ২২৫ বক্সে প্রতি কেজি ৬১৯ দশমিক ২০ টাকা দরে রপ্তানি হবে এ চা।

 

কোম্পানিটির চিফ অপারেটিং অফিসার তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পাকিস্তানে আমাদের উৎপাদিত গ্রিনটির পুরোনো বাজার ছিল এবং এখনো আছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রতি বছর সেখানে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চা রপ্তানি করি। কোভিড মহামারির আগে পাকিস্তানে আমরা প্রায় ২-২.৫ লাখ কেজি চা রপ্তানি করতাম।’

 

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের চায়ের দাম অনেক কমাতে হবে, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমাদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার, কীটনাশক, শ্রমিকের বেতন খরচ অনেক বেড়েছে। কেনিয়ায় প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন চার হাজার কেজি, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন মাত্র ১৫শ কেজি। ফলে কেনিয়া যে দামে চা বিক্রি করতে পারবে আমরা সেই দামে পারবো না।’

 

সমস্যা থেকে উত্তরণে তিনি সরকারি ভর্তুকি, চা আইন উৎপাদনকারীদের জন্য সহজ করা, আর্থিক সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করা, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

 

টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শাহ মঈনুদ্দিন হাসান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার প্রেক্ষাপটে নগরায়ণ বেড়েছে, যে কারণে বাড়ছে চায়ের ভোক্তা। অভ্যন্তরীণ বাজারেও চাহিদা উৎপাদন হারের মতোই বাড়ছে। যে কারণে বিশ্ববাজারের চেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারেই ভালো দাম মিলছে চায়ের। ফলে রপ্তানিতে মনোযোগ কম।’

 

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ চা রপ্তানিতে অনেক পিছিয়ে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ দশমিক ৪ লাখ কেজি চা রপ্তানি হয়েছে, যেখানে ওয়ার্ল্ড ইন্টিগ্রেটেড ট্রেড সলিউশনের তথ্যমতে, শ্রীলঙ্কা রপ্তানি করেছে ১৩ কোটি ৫৬ লাখ কেজি এবং ভারত ২০ কোটি ৪১ লাখ কেজি চা রপ্তানি করেছে।

 

কেন বাংলাদেশ রপ্তানিতে পিছিয়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে শাহ মঈনুদ্দিন বলেন, ‘দু-তিন বছর আগেও আমাদের রপ্তানি করার মতো চা ছিল না। এছাড়া আমাদের চায়ের দাম অন্য দেশের তুলনায় বেশি। কারণ আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি এবং উৎপাদনশীলতা কম। মান উন্নয়ন ও পণ্যের বৈচিত্র্য ছাড়া গতানুগতিক রপ্তানি পন্থায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না।’

 

বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান এবং দ্য কাপনা টি কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরান টি রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রায় এক কোটি কেজি চা বেশি উৎপাদন হচ্ছে। একটা সময় আমরা চা বিদেশে রপ্তানি করতাম, যা এখন পুরোটাই দেশীয় বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। এখন রপ্তানি করার মতো চা নেই, যা উৎপাদন হয় তার ৯২ শতাংশই দেশের চাহিদা পূরণ করতে লেগে যায়। এছাড়া চা কোথায়, কীভাবে, কোন দামে রপ্তানি করা হবে সেটিও একটি সমস্যা। আমরা চা রপ্তানি করতে চাই। এজন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।’

 

বাংলাদেশীয় চা সংসদের সাধারণ সম্পাদক কাজী মোজাফফর আহাম্মদ বলেন, ‘রপ্তানির মতো চা উৎপাদন করার টি-এস্টেট ও চায়ের জাত অপ্রতুল। ক্রেতারা এই চা কিনবে কি না বা কিনলেও কোন দামে কিনবে সেটিও একটি প্রশ্ন।’

 

চা-শ্রমিকদের দাবি

 

বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্থায়ী শ্রমিকদের কম বেতন দেওয়ার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বাচাশ্রই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি এ বিষয়ে বলেন, ‘অনেক কোম্পানি তাদের স্থায়ী চা-শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত ১৭৮ টাকা দিলেও অস্থায়ী শ্রমিকদের প্রায় ৫০-৬০ টাকা কম মজুরি দেয়। শ্রম আইন অনুযায়ী অস্থায়ী শ্রমিকরা স্থায়ী শ্রমিকদের সমান মজুরি ও অন্য সুবিধা পাবে, কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে বৈষম্য করছে।’

 

বাচাশ্রইর কোষাধ্যক্ষ পরেশ কালিন্দি বলেন, ‘মালিকপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী তারা শ্রমিকদের ‘ক্যাশ অ্যান্ড কাইন্ড’ দিচ্ছে। যেখানে ১৭৮ টাকা ক্যাশ এবং রেশন সাবসিডি, হাউজ ফ্যাসিলিটি, হেলথ ফ্যাসিলিটিসহ অন্য বিষয়কে তারা কাইন্ড বলে মোট মজুরি ৫৭০ টাকা বলছেন, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’

 

শ্রম আইনের ‘ধারা ২ এর দফা ৪৫(ক) অনুযায়ী বাসস্থান সংস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা বা অন্য কোনো সুবিধা প্রদানের মূল্য অথবা সরকার কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা বাদ দেওয়া হইয়াছে এইরূপ কোনো সেবার মূল্য, মজুরির অর্ন্তভুক্ত হবে না।’

কিন্তু মালিকরা ‘কাইন্ড’ বলে এগুলোকে মজুরির অন্তর্ভুক্ত করে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। বলেন পরেশ কালিন্দি।

Sharing is caring!