প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

নানা দাবিতে সরগরম সচিবালয়, তিন মাসেও ফেরেনি কর্মপরিবেশ

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১০, ২০২৪, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ
নানা দাবিতে সরগরম সচিবালয়, তিন মাসেও ফেরেনি কর্মপরিবেশ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে নতুন সরকারের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে স্থিতিশীল কর্মপরিবেশ এখনও ফিরে আসেনি। সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে নানা দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ-সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে।

কার্যালয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে বিভিন্ন দাবিতে কখনও করিডোরে আবার কখনও নিজ দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তার দফতরের প্রধান ফটকে বিক্ষোভ মিছিল, স্লোগান, পাল্টা স্লোগান এখনও চলছে। কখনও পদোন্নতির দাবি, কখনও বেতন বাড়ানোর দাবি— এমন নানা বিষয়ে কর্মসূচি পালন করছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। এসব আচরণ শুধু সরকারি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘনই নয়, সাধারণ জনগণকে সরকারি সেবাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ ধরনের আচরণ সরকারি চাকরিবিধি ২০১৮-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

জানা গেছে, চলতি বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে নতুন রাষ্ট্র গড়তে সংস্কারের নির্দেশ আমলাদের কাছে শিরোধার্য হলেও নিম্নস্তরের কর্মচারীদের দাপটে সচিবালয়ের কর্মপরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন প্রশাসনের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। একইভাবে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন করা নিয়ে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই চলছে এমন পরিস্থিতি। আনসার বিদ্রোহের পরে সরকার আদেশ জারি করে সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিল-মিটিং বন্ধ করতে পারলেও সচিবালয়ের ভেতরের কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। এখনও সচিবালয়ের আনাচে-কানাচে, অভ্যন্তরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নামাজের নির্ধারিত স্থান বা ক্যান্টিনে বৈঠক ও শলা-পরামর্শ চলছে। একাধিক সচিবের সঙ্গে কথা বলে এবং পুরো সচিবালয় ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।

দেখা গেছে, একটি রাজনৈতিক দলের সরাসরি সমর্থক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাপটে সচিবালয়ে এখনও অস্বাভাবিক কর্মপরিবেশ বিরাজ করছে। মুখে না বললেও এসব কর্মচারীর আচরণে এখনও উদ্বেগে রয়েছেন সচিবরা। সরকারের শীর্ষ মহলের উদ্যোগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনও কোনও মিটিংয়ে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে— স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার মদতপুষ্ট প্রশাসন ভেঙে ফেলতে হবে। সেখানে নিয়োগ দিতে হবে পদবঞ্চিতদের। এর অংশ হিসেবে কাউকে কাউকে নিয়োগ দেওয়াও হয়েছে, আলোচনা চলছে আরও দেওয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে নিজের পদ-পদবি ঠিক থাকবে কিনা এ নিয়ে সারাক্ষণই আতঙ্কে রয়েছেন সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতে সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার পরিধি কমছে।

সূত্র জানিয়েছে, অফিস চলাকালে সচিবালয়ে নিজ কক্ষের দরজায় দলবেঁধে শব্দ হলেই ঊর্ধ্বতনরা মনে করছেন— এই বুঝি পদবঞ্চিত, সুযোগবঞ্চিত পরিচয়ে কর্মচারীরা অপমান-অপদস্থ করতে এলো। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ বাস্তবায়নের কী হবে তা নিয়ে শঙ্কিত তারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে নতুন রাষ্ট্র গড়তে সংস্কারের নির্দেশ শিরোধার্য হলেও কর্মপরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় সচিবরা।

সূত্র জানিয়েছে, পদনাম পরিবর্তন, টিপটপ ভাতা প্রদান, নতুন বেতন কাঠামো প্রবর্তন এবং ব্লকড পদে পদোন্নতির দাবিতে আন্দোলনে উত্তাল প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়। প্রকাশ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীদের জনপ্রশাসন সচিবের দফতর ঘেরাও করে পদোন্নতির দাবিতে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। এদিকে বিসিএস ১৩তম থেকে ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আবেদন করেছেন। ওই স্মারকলিপিতে তারা ২০০২ সালে প্রণীত সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালার বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি করেন। এই মুহূর্তে ১৯৪ জন কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত রয়েছেন বলে তারা জানান। বিধিমালা অনুযায়ী, প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং (অন্য ২৫টি ক্যাডার) আদার্স ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। একইভাবে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবও পদোন্নতি পাচ্ছেন। তারা মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতিতে সমতা নিশ্চিতের দাবি জানান। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কর্মচারী-নেতাদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়গুলো সংশোধন ও পরিবর্তনে কাজ চলছে।

জানা গেছে, ১৬ বছর ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একমাত্র সংগঠন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ বিগত সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত-সাময়িক বরখাস্ত ও অন্যায়ভাবে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্তদের মতো পাওনা ফেরত, বিভিন্ন ক্যাটাগরির পদ সংরক্ষণ, পদনাম পরিবর্তন, নতুন পে-কমিশন গঠনসহ ৯ দফা দাবি দিয়েছে সরকারকে। দ্রুত এসব দাবি বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি। রবিবার (৩ নভেম্বর) সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহমেদ এ তথ্য জানিয়েছেন। এভাবেই এখনও চলছে দাবি আদায় কার্যক্রম।

এদিকে, সরকারি চাকরিবিধি-২০১৮ অনুযায়ী সরকারি অফিসের নিয়ম ও শৃঙ্খলা-লঙ্ঘন করলে চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর তাই এটি কেউ সরকারি চাকরি চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে তালিকায় রাখতে পারেন। কেননা, কেউ যদি অফিসের নিয়ম লঙ্ঘন করেন, তাহলে সেটা অফিসের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায় এবং অন্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর জন্য সাময়িক সময়ের জন্য হোক, অথবা চিরতরে অভিযুক্ত কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হতে পারে।

একইভাবে কর্মস্থলে অসদাচরণ করলেও তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনও কিছু পাওয়ার দাবিতে কোনও কর্মকর্তার দরজায় আঘাত করলে, গলা উঁচিয়ে তার সামনে দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে তা উপস্থাপন করা অসদাচরণের শামিল, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক কথায় বলা যেতে পারে এমন অভিযোগে চাকরি ডিসমিস হতে পারে। চাকরি চলে যাওয়ার পেছনের একটি অন্যতম প্রধান কারণ এটি। আর এই অসদাচরণ মূলত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন- সহকর্মীদের সঙ্গে মিসবিহেভ করা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অফিসের নিয়ম-কানুন ভঙ্গ, এমনকি অনৈতিক কার্যক্রমও অসদাচরণের শামিল।

সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী কাজের প্রতি অবহেলাও একজন সরকারি কর্মচারীর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকারি চাকরি চলে যাওয়ার বা যেকোনও চাকরি চলে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে একটি পরিচিত কারণ কাজের প্রতি অতিরিক্ত অবহেলা। অফিস সময়ে নিজ দফতরে অনুপস্থিত থেকে নিজের বা সমষ্টিগত দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য যেকোনও মুভমেন্ট কাজের প্রতি অবহেলা বলে বিবেচিত হবে। সরকারি কর্মচারীদের মনে রাখা উচিত, এটিও চাকরি চলে যাওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ।

কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত অনুপস্থিত ও দেরিতে আসা চাকরি চলে যাওয়ার আরেকটি কারণ। কেননা এটি অফিসের শৃঙ্খলাভঙ্গ করে এবং সহকর্মীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। এজন্য টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখতে হবে। এটি না করা চাকরিবিধি অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক কেবিনেট সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার যেকোনও কৌশলই দণ্ডনীয় অপরাধ। নিজেদের বা গোষ্ঠীগত দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন দাখিলই একমাত্র পথ। এ ক্ষেত্রে বিক্ষোভ মিছিল করা, ডিউটির সময়ে দফতরে অনুপস্থিত থাকা, কোথাও গণ্ডগোল পাকানো—সবই সরকারি চাকরিবিধিতে অপরাধযোগ্য কাজ।

জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে যেকোনও উদ্দেশ্যে সরকারকে চাপে রাখার যেকোনও কৌশলই অপরাধ। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে দফতরে অনুপস্থিত থাকাটাও শাস্তিযোগ্যও অপরাধ। এ বিষয়ে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। সম্প্রতি যারা এসব কাজে যুক্ত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Sharing is caring!