প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশে রাজনীতি বিভাজন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই বিভাজন-বিভক্তি শুধু দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক আদর্শের কারণে মানুষে-মানুষে বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অসাধু ও সুবিধাবাদীদের রাজনীতিতে আশ্রয়-প্রশ্রয়ের নজির এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা শুধু কঠিন নয়; অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক বিভাজন ও দলবাজিতে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত। এতে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত, আইনশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। ফলে রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার স্থায়ী সমাধানে পৌঁছতে হবে। নইলে জাতি হিসেবে আমাদের অনেক পিছিয়ে যেতে হবে।
দেশে সুশাসন ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো হলো বিচার বিভাগ। সর্বোচ্চ মর্যাদা ও জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল এটি। অথচ সেই বিচার বিভাগই এখন কাঠগড়ায়। সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ও দলবাজির অভিযোগে আন্দোলনের মুখে গত ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, বিচারপতি থাকা অবস্থায় দুজন তাদের বক্তব্যে নিজেদের রাজনীতিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। এ ছাড়া রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট উল্লেখ করে বর্তমানে দায়িত্ব পালনরত প্রায় ৫০ জন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তুলেছেন আইনজীবীরা। আপিল বিভাগের সাবেক এক বিচারপতি সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি বেপরোয়া পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন মর্মে অভিযোগ আইনজীবীদের। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, ওই বিচারপতি রায় ঘোষণার পর অবসরে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন। লিখিত রায়ে আগের আদেশের অংশ (অর্ডার পোর্শন) পরিবর্তন করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে সেই বিচারপতিকে স্যাডিস্ট (যে অন্যকে অপদস্থ করে আনন্দ পায়) বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। দলীয় বিবেচনায় হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের কারণে আজও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদৃঢ় নয়। যে কারণে বিচার বিভাগ আজ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। তাই বর্তমান সরকারকে বিচারব্যবস্থায় সার্বিক সংস্কারের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে জনপ্রশাসনে এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফেরেনি। বিগত সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তারা চাপে থাকলেও আরেকটি পক্ষ নিজেদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে পারছে না। সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে বলতে শোনা গেছে, তারা আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় পদোন্নতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছেন। সেই বঞ্চিতরা এখন তাদের শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যস্ত। আবার রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের ক্ষমতায়নের দৃঢ়তা প্রকাশ পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে অধিকাংশ আমলা তাদের শিক্ষাজীবনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ক্যাডার হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। শুধু স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশই নয়, সরকারদলীয় ক্যাডার হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সেবার পরিবর্তে শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন তারা। বাধাহীনভাবে জড়িয়ে ছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতিতে। সরকার পরিবর্তনের পর সেই সব কর্মকর্তা প্রবল চাপের মুখে এখন প্রায় নিষ্ক্রীয়। দলীয় পরিচয়ে চিহ্নিত অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, কেউ কেউ নিজ থেকেই চাকরি ছেড়েছেন। ফলে দেশের জনপ্রশাসন কাঠামো এখন খুবই নড়বড়ে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা অপরিহার্য। অথচ ২০০৯ সাল থেকে সাড়ে ১৫ বছরে কোনো নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যায়নি। বরং এই দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট নিবার্চন কমিশন দেশে-বিদেশে শুধু নেতিবাচক সমালোচনাই কুড়িয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে ভোটের আগেই ভোট সম্পন্ন, ভোটের ফলাফল পাল্টে ফেলা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না করাসহ নানা অভিযোগ নিয়ে সব নির্বাচন কমিশনকে বিদায় নিতে হয়েছে। সব শেষ আন্দোলনের মুখে গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা। নির্বাচনে ধারাবাহিক অপকর্মের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনব্যবস্থাও ধ্বংসপ্রায়।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি অপকর্মের অভিযোগ এসেছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। সাড়ে ১৫ বছরে পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সরকারের নির্দেশে সব ক্ষেত্রে নির্বিচারে বিরোধীদের ওপর হামলা-মামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন চালানো হয়েছে। এমনকি কারণে-অকারণে সাধারণ মানুষের ওপরে চলেছে অমানবিক নির্যাতন। শুধু পুলিশ নয়; র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনসহ (পিবিআই) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এক ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের জন্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে র্যাবের সাবেক শীর্ষ ৬ কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নিপীড়নে অতিষ্ঠ দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো পুলিশকে শত্রু মনে করে। এ অবস্থায় ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সবচেয়ে বেশি জনরোষের শিকার হয়েছে পুলিশবাহিনী। আন্দোলনকারীদের হাতে প্রাণ গেছে ৪৪ জন পুলিশ সদস্যের। থানা কার্যালয়সহ পুলিশের অসংখ্য স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ফলে পুলিশবাহিনী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এখনো মনোবল ফিরে পায়নি। বলা যায় দলবাজির কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থা খুবই নাজুক।
গত ১৫ বছরে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগের প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সরকারে আজ্ঞাবহ দুদক সম্প্রতি সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিষয়ে প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করেছেন। তবে সফলতা নিয়ে শঙ্কা কাটেনি। কারণ যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে এখন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, বিগত সরকারের আমলেই তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংবাদ ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। দুদকে অভিযোগ দাখিল করেও কোনো লাভ হয়নি। কেউ কেউ হাইকোর্টে আবেদন করে অনুসন্ধানে বাধ্য করার চেষ্টা করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয়, দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার তাদের চেয়ার বাচাতে এবং বর্তমান সরকারকে খুশি করতে লোক দেখানো অনুসন্ধান শুরু করেছেন। প্রকৃতপক্ষে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা এখনো ফেরেনি। অবশ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের কঠোর অবস্থান প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছে।
দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের কারণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনও (পিএসসি) ছিল সরকারের আজ্ঞাবহ। যে কারণে আন্দোলনের মুখে গত সপ্তাহে পিএসসির চেয়ারম্যানসহ সদস্যরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগের প্রধান কাজটি করে পিএসসি। বছরের পর বছর বঞ্চনার শিকার হয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যখন কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে রাজপথে নামেন, ঠিক তখন বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কতিপয় ব্যক্তির সীমাহীন দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সঙ্গে পিএসসির শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। একইভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ। নানাভাবে পিএসসির মতো প্রতিষ্ঠান এখন ধ্বংসের মুখে। তাই বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধাবীরা যাতে সুযোগ পায়, এ জন্য পিএসসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিয়োগ-বাণিজ্য, প্রশ্নফাঁস ও স্বজনপ্রীতির পথ চিরতরে বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষাব্যবস্থায় ধ্বংস ডেকে আনার পেছনে অন্যতম দায়ী সরকারের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগ পাওয়া ইউনিভার্সিটি গ্রান্ড কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভিসি নিয়োগেও উচ্চ শিক্ষায় এর প্রভাব পড়তে পারে। ইউজিসিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, নিয়োগ, পদোন্নতি, তদারকি, পরিদর্শন, তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা, পরীক্ষার ফলাফলের স্বচ্ছতা বিধান, সার্টিফিকেট ব্যবস্থাপনা, পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। এসবের কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘প্রতিটি নিয়োগ স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচাতে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এমন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, কেউ যাতে দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com