প্রজন্ম ডেস্ক:
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পোশাক পরে ডাকাতি, ছিনতাই, টাকা লুট ও অপহরণের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের পরিচয়ে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কাউকে তুলে নিয়ে নির্যাতন, গুম কিংবা ডাকাতির ঘটনায় অপরাধীদের ধরতে বেগ পেতে হয় পুলিশের।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরেও এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ভুয়া ডিবি, র্যাব কিংবা সেনাবাহিনীর পরিচয়ে টাকা লুট কিংবা অভিযানের নামে অপকর্ম করছে অপরাধীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সরকারের সময়ে যারা এসব অপরাধে জড়িত ছিল তাদের কেউ কেউ কারামুক্ত হয়ে আগের পেশা হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয়ে নকল পোশাকে অপকর্মে জড়াচ্ছে। কেউ আবার অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এসব অপরাধ করছে। এসব অপকর্ম করে দোষ চাপাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। অপরাধীদের মধ্যে আবার কেউ আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য। তারা এসব অপকর্ম খুব নির্ঝঞ্ঝাটভাবে করেন।
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পোশাক পরে ডাকাতির ঘটনায় জনমনে শঙ্কা ও উদ্বেগ বেড়েছে। বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ীরা রয়েছেন অনেকটা আতঙ্কে। অভিযানের কথা বলে কে কখন বাসায় কড়া নাড়েন সে ভয়ও কাজ করছে অনেকের মধ্যে।
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল একটি বাসা থেকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের মাথায় এমন সংবাদ জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। যদিও এ ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও র্যাব। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পাঁচজনই হলেন বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য।
সেনাবাহিনী-র্যাবের পোশাক পেলো কোথায়?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশের মার্কেটে সেনাবাহিনীর পোশাক কিনতে পাওয়া যায়। এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর এসব পোশাক বিক্রি করেন। যাদের কাছে বিক্রি করেন তাদের বেশিরভাগই অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। রাজধানীর কচুক্ষেতে সেনাবাহিনীর পোশাক বিক্রি করেন কিছু ব্যবসায়ী।
শুধু সেনাবাহিনীর পোশাকই নয়, পুলিশ, ডিবি, র্যাব এমনকি বিজিবির পোশাক, ক্যাপ, হেলমেট, আইডি কার্ডও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয়। অপরাধী চক্রের কিছু নির্দিষ্ট দোকান রয়েছে, সেখান থেকেও তারা এসব পোশাক বেশি দামে সংগ্রহ করে থাকেন।
মোহাম্মদপুরে ডাকাতির ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে ডাকাতরা কীভাবে সেনাবাহিনীর পোশাক, হেলমেট ও র্যাবের পোশাক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পেয়েছে? এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে তারা এর আগে কী কী ধরনের অপরাধ করেছে, সেগুলো নিয়েও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতদের প্রথমে ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৪ অক্টোবর সাতদিনের রিমান্ডে পায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি। সেনাবাহিনীর সাবেক ল্যান্স করপোরাল কামাল হোসেনকে বুধবার (১৬ অক্টোবর) পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়া আরেকজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র অডিট অফিসার আলমগীর হোসেনের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয় বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর)।
রিমান্ডে আসামিদের পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। চোরাই মালপত্র শনাক্ত এবং উদ্ধার, অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাতদের শনাক্ত এবং গ্রেফতার, অপরাধের কৌশল এবং প্রক্রিয়া জেনে মূল ঘটনার রহস্য উদঘাটন, জড়িত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং এই ডাকাতদল আগে কী কী অপরাধ করেছে তার তথ্য উদঘাটন।
গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই গ্রুপটি আরও একাধিক ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছে। মোহাম্মদপুরের আগে অন্তত চার জায়গায় ডাকাতির চেষ্টা করেছিল বলে তারা স্বীকার করেছে। আগের চেষ্টাগুলো ব্যর্থ হলেও তারা সফল হয়েছে মোহাম্মদপুরে। সেখান থেকেই তারা সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে।
ডাকাতিতে জড়িত র্যাব-বিজিবির চাকরিচ্যুত সদস্যরা
জানা গেছে, মোহাম্মদপুরে ডাকাতির ঘটনায় র্যাবের কয়েকজন সদস্য জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তাদের আটক করেছে র্যাব। এর মধ্যে তিনজন র্যাব-৪ এর সদস্য এবং দুজন অন্য দুটি বাহিনীর সাবেক সদস্য। আটক র্যাব সদস্যরা হলেন মোস্তফা, আরিফ ও ইমাম। তাদের বিভিন্ন বাহিনী থেকে র্যাবে পদায়ন করা হয়েছিল। মিরপুরে র্যাব-৪-এর ব্যাটালিয়ন অফিসের আশপাশের অপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে তারা মোহাম্মদপুরে ওই ডাকাতিতে অংশ নেন।
র্যাব যে তিনজনকে ডিবির কাছে হস্তান্তর করেছে তারা হলেন- শাহ আলী থানা এলাকার আরিফুল ইসলাম তালুকদার, ঝিনাইদহের জাহিদ হাসান ও মুন্সিগঞ্জের আব্দুস সালাম। একই ঘটনায় ডিবি পুলিশও তিনজনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- মিরপুরের পাইকপাড়ার জাকির হোসেন, শরিফুল ইসলাম তুষার ও কাফরুলের মাসুদুর রহমান। তাদের মধ্যে মাসুদুর রহমান বিজিবির চাকরিচ্যুত সদস্য। তিনি ২০০০ সালে বিজিবিতে চাকরি শুরু করেন। চাকরিচ্যুত হন ২০১০ সালে। এই ছয়জনকে সাতদিনের রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি পুলিশ।
ডাকাতির ঘটনায় বাড়ির মালিক ব্যবসায়ী আবু বক্কর মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ রাকিব খান বলেন, ‘মামলার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে। রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি আমরা। তাদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিটি তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মোটামুটি ঘটনার ডিটেক্ট করতে পেরেছি। ডাকাতির ঘটনায় জড়িতদের বেশিরভাগ সদস্যদের শনাক্ত করা গেছে। এখন যাচাই-বাছাই চলছে।’
বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতরাই অপকর্মের হোতা
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যরা বাহিনীর পোশাক কোথায় কীভাবে কিনতে পাওয়া যায় তারা আগে থেকেই জানেন। এছাড়া অস্ত্র-ওয়াকিটকি ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতো কীভাবে অভিযান চালানো হয়, সে সম্পর্কেও ধারণা রয়েছে তাদের। অপকর্মে যুক্ত থাকার প্রমাণ মেলায় এসব সদস্যকে বাহিনীকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুতসহ শাস্তির আওতায় আনা হয়। শাস্তি শেষে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন না করে পোশাকসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি অবৈধভাবে কিনে বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হন। এতে একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে, অন্যদিকে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সেনা পরিচয়ে চাঁদাবাজি-তল্লাশির বিষয়ে আইএসপিআরের সতর্কতা
সেনাবাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালাচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল বা গোষ্ঠী। তারা ফোনকলের মাধ্যমে চাঁদাবাজির চেষ্টা করছে। জনসাধারণকে প্রতারিত না হয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। গত ২১ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর জানায়, ইদানীং পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে বেসামরিক পোশাকে সরকারি অফিস, করপোরেট অফিস, পারিবারিক বাসস্থান, শপিংমল ও দোকানে তল্লাশি চালাচ্ছে এবং ফোনকলের মাধ্যমে চাঁদাবাজির চেষ্টা করছে।
আপনাদের সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেসামরিক পোশাকে এবং অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (পুলিশ ও র্যাব ইত্যাদি) উপস্থিতি ছাড়া কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা করে না। তাই জনসাধারণকে প্রতারিত না হয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাচ্ছে আইএসপিআর।
বাহিনীর পোশাক বিক্রয়যোগ্য নয়
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (লজিস্টিক) নাসিমা আক্তার বলেন, ‘পুলিশের পোশাক বিক্রয়যোগ্য নয়। পুলিশের পোশাক যারা বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
বিজিবির মিডিয়া উইংয়ের উপ-মহাপরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘বিজিবিতে কোনো সদস্য অপকর্মে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে অনেককে চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে।’
বিজিবির পোশাক বাইরে কিনতে পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইলে শরীফুল ইসলাম বলেন, নির্দিষ্ট মাধ্যমে বিজিবির ইউনিফর্ম সাপ্লাই দেওয়া হয়। বাইরের কোনো দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না।
তদন্ত চলমান
জানতে চাইলে আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী বলেন, মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ঘটনায় তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আজ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধেই যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, মোহাম্মদপুরের ঘটনায় তদন্তে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া ডাকাতিতে জড়িতরা কীভাবে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাকসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি পেলো সে বিষয়েও তদন্ত চলছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে মুনীম ফেরদৌস বলেন, কচুক্ষেতসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টগুলোতে সেনাবাহিনীর পোশাক কিনতে পাওয়া যায়। এটা বিক্রি নিষিদ্ধ। যারা বিক্রি ও নকল তৈরি করে, এমন অনেকের বিরুদ্ধে অভিযানও পরিচালনা হয়েছিল।
কঠোর শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে ডাকাতির ঘটনাটি সবদিক দিয়েই আমাদের সবাইকে অবাক করেছে। অতীতেও ভুয়া পুলিশ, র্যাব ও ডিবির পরিচয় দিয়ে ডাকাতি-অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই ঘটনা পূর্বের ঘটনার সঙ্গে নতুন কিছু মাত্রা যোগ করেছে। বিভিন্ন বাহিনীর পোশাক বাইরের মার্কেটে কিংবা দোকানে কিনতে পাওয়া যায়; এটা উদ্বেগের। যারা এগুলো বিক্রি করছে কিংবা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের সবাইকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। অন্যথায় সমাজে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যেতে পারে।
Sharing is caring!