![](https://www.agamiprojonmo.net/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
প্রজন্ম ডেস্ক:
প্রচলিত প্রবাদের ভাষায় বলতে গেলে এমন কথা বলাই যায় যেÑ তারা ‘গাছেরও খায় তলারও কুড়ায়’। তারা হলেনÑ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার যে নির্বাচনী প্রহসন, তার অন্যতম কুশীলব। জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদাধিকারী এই কর্মকর্তারাই ছিলেন ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ আয়োজনের অন্যতম কারিগর।
বিতর্কিত সেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সকল ডিসি ও রিটার্নিং কর্মকর্তা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের জেরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বহু মন্ত্রী-এমপি ও রাজনীতিবিদ পালিয়ে গেলেও সেই ডিসিরা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। শুধু যে বহাল রয়েছেন তা নয়, বলা যায়Ñ এখনও তারা আছেন ‘জামাই আদরে’। অথচ এই ডিসিরাই ছিলেন রাতের ভোটের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী। বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশনা অনুযায়ী তারাই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এর পুরস্কারও পেয়েছেন হাতে হাতে। আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পর সব ধরনের সুবিধা পেয়েছেন একান্ত ‘অনুগত’ এই কর্মকর্তারা। পদোন্নতি, পছন্দনীয় পদায়নসহ অঢেল সুযোগ-সুবিধা তারা পেয়েছেন বিগত সরকারের কাছ থেকে। দেশে-বিদেশে, নামে-বেনামে কত যে সম্পদ তারা গড়েছেন, তার সীমা-পরিসীমা নেই!
জানা গেছে, বিগত সরকারের নানা অপকর্মের দোসর হিসেবে স্বীকৃত এসব কর্মকর্তার অনেকেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। এ নিয়ে অসন্তোষ, অভিযোগের অন্ত নেই। যার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী অনিয়মে জড়িত ডিসিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিত ওই নির্বাচনে কত টাকা অপচয় হয়েছে, কারা সরাসরি অনিয়মে জড়িত ছিলেন, কীভাবে ভোটারবিহীন নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট কাস্টিং দেখানো হয়েছে এবং এই অপকর্মে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে কারা কী পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হবে অনুসন্ধানে। দুদকের এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করার কথা জানা গেছে। ওই কমিটি শুধু ডিসি নয়, তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জের ডিআইজি, পুলিশের এসপিসহ ভোটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করবে। দুদকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেছেন, ‘২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দিনের ভোট আগের রাতেই করে ফেলার অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ লক্ষ্যে একটি টিম গঠন করা হবে। ওই নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম, যেমনÑ দিনের ভোট রাতে করা, ব্যালট জালিয়াতি, অনেক কেন্দ্রে অবিশ্বাস্যভাবে ৯০ শতাংশের বেশি কাস্টিং দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো ইত্যাদি অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দুদক অনুসন্ধান করবে।’
সূত্র জানায়, গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী আমলে অনিয়মে জড়িত ডিসিরা ভোল পাল্টে সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। অনেকেই রাতারাতি অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন। যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হয়েও তারা এখনও রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বহাল রয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সহযোগিতায় রাতের ভোটের পরিকল্পনায় ডিসিদের পাশাপাশি তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনাররাও বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশেই পুলিশ, প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা ভোটারবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করেছিলেন। ওই নির্বাচনের পর এই ডিসিরা পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। কেউ বিভাগীয় কমিশনার, কেউ বিভিন্ন অধিদপ্তরের প্রধান হয়েছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলেও তারা সেসব পদে কীভাবে আসীন রয়েছেনÑ তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এপিডি) মো. ওবায়দুর রহমান জানান, দুদক থেকে চিঠি আসার কথা তার জানা নেই। তবে দুদক থেকে এ ধরনের তালিকা চাওয়া হলে তাদের সেটা দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ কালো টাকার ছড়াছড়ি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সিভিল প্রশাসনের অন্যান্যদের পেছনে এ টাকা ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি সরকারদলীয় ক্যাডারদের মধ্যে অর্থ বিলানো হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ আগাম বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৭২ কোটি টাকা। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আওয়ামী লীগ ২০১৭ সাল থেকেই দলীয় অনুগত কর্মকর্তাদের দিয়ে বিভিন্ন স্তরে জনপ্রশাসন সাজাতে উদ্যোগী হয়। সেই সাজানো প্রশাসন দিয়েই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই ২৫৮টি আসনে জয়ী হয়। অনুগত জেলা প্রশাসকরা তাদের প্রার্থীদের সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করেন। ভোটার উপস্থিতি না থাকলেও উপস্থিতি দেখানো হয় ৮০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় মোট ভোটের ৭৪.৪৪ শতাংশ। যা অবিশ্বাস্য বলে বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে উল্লেখ করা হয়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং ১ হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে।
নির্বাচন নিয়ে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) এক গবেষণায় বলা হয়, ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতে কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে। ওই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩টি। সমানসংখ্যক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী প্রিসাইডিং, পোলিং কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীসহ সাত লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। দায়িত্ব পালনের আগে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই করে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তাদের তদন্তে বিরূপ মন্তব্য থাকায় নির্বাচনী দায়িত্বের বাইরে রাখা হয় বহু কর্মকর্তাকে।
তবুও তারা বহাল তবিয়তে
ভোটারবিহীন নির্বাচনে সহায়তা করার অভিযোগ থাকার পরও অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কীভাবে সেই অসাধু কর্মকর্তারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেনÑ তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। অনেকেই এরই মধ্যে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আস্থাভাজনও হয়ে উঠেছেন। বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও শেরপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আনারকলি মাহবুব ওই সময় শেরপুরে রিটার্নিং অফিসার ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদোন্নতি পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে তার পদায়ন হয়েছিল। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পরও তিনি সেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে (জেলা ও মাঠপ্রশাসন অনুবিভাগ) যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাতের ভোটে দায়িত্ব পালনকারী আরেক কর্মকর্তা, সুনামগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়াধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (পরিকল্পনা) পদে পদায়ন হয়েছেন। বিসিএস ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা ঝালকাঠির সাবেক জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক বর্তমানে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক তিন জেলা প্রশাসক। তারা হলেনÑ পটুয়াখালীর সাবেক ডিসি মতিউল ইসলাম চৌধুরী, দিনাজপুরের মাহমুদুল আলম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হায়ত-উদ-দৌলা খান। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত লক্ষ্মীপুরের সাবেক ডিসি অঞ্জন চন্দ্র পাল। চাঁদপুরের সাবেক ডিসি মো. মাজেদুর রহমান শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, গোপালগঞ্জের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে রয়েছেন। এ ছাড়া নরসিংদীর সাবেক ডিসি ও যুগ্ম সচিব সৈয়দা ফারহানা কাওনাইন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে, শরীয়তপুরের সাবেক ডিসি কাজী আবু তাহের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন ও বাজেট), ঢাকার সাবেক ডিসি আবু সালেহ মো. ফেরদৌস খান পরিকল্পনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বান্দরবানের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইআইটি), রাঙামাটির সাবেক ডিসি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ শফিউল আরিফ। তিনি লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক ছিলেন। এরপর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এপিডি অনুবিভাগে পদায়ন করা হয় তাকে। বগুড়ার সাবেক ডিসি ফয়েজ আহমেদ বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক ও যুগ্ম সচিব এজেডএম নুরুল হক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে, বাগেরহাটের সাবেক জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। চুয়াডাঙ্গার সাবেক ডিসি গোপাল চন্দ্র দাস সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে, বরগুনার কবির মাহমুদ ও গাইবান্ধার আব্দুল মতিন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক, খুলনার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ হেলাল হোসেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে, ভোলার মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিকী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সচিব, সিলেটের কাজী এমদাদুল ইসলাম সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (স্থানীয়) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। রংপুরের সাবেক ডিসি ড. এনামুল হাবীব রয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে পরিচালক হিসেবে। এভাবে অন্যরাও স্বরূপ আড়াল করে নিয়োজিত রয়েছেন বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে।
Sharing is caring!