প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২০শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

তত্ত্বাবধায়ক সরকার: বাস্তবায়নে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ২৯, ২০২৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার: বাস্তবায়নে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনি লড়াইও করছে বিএনপি-জামায়াত। সাধারণ মানুষ মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেই কেটে যাবে দেশে এক যুগের বেশি সময় ধরে চলে আসা রাজনৈতিক অচলাবস্থা।

তবে বিশিষ্টজনরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা এসেছিল, আবার তা চলেও গিয়েছিল। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকার পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করাতে মনে হচ্ছে যে, এটি ফিরে এলেই স্বস্তি মিলবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব বিতর্ক উঠেছিল তার সমাধান না করলে দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা থেকেই যাবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আপিল বিভাগে একটি মামলায় লড়ছেন নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনেরও প্রধান, যার নেতৃত্বে কমিশন এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ-সংক্রান্ত সুপারিশও জমা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মামলায় জিতলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার পথ তৈরি হবে। তবে এর মানে এই নয় যে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ফিরিয়ে আনলে সেখানেই স্পষ্ট হবে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীরূপে ফিরছে।

তিনি বলেন, ‘বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই হবে নাকি অন্য রকম হবে। সংসদে নিশ্চয়ই এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে আমাদের বিগত দিনের যে অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে যেন সেই জটিলতাগুলো ফিরে না আসে, সংসদে নিশ্চয়ই এই নিয়ে আলোচনা হবে।’

‘এককথায় আমরা মামলায় জিতলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনতে আদালতের নির্দেশ থাকবে। কিন্তু তা কীরূপে ফিরবে, আগের জটিলতাগুলো থাকবে কি না, তা ঠিক করবে সংসদ, আদালত নন’ যোগ করেন দেশের বিশিষ্ট এই নাগরিক।

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান বলেছেন, “এখন যদি আপাতত সমাধানের জন্য সেই আগের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই ফিরে আসে, তাহলে তো সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’। সমস্যার সমাধান তো হলো না। পুরোনো সমস্যাই ফিরে এল। যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতে এ-সংক্রান্ত একটি মামলা বিচারাধীন আছে, তাই আশা করছি সেখান থেকে কোনো পর্যবেক্ষণ আসবে। তবে চূড়ান্ত সমাধান যাই হোক, রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া হবে না।”

সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ, এরপর যথাক্রমে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রধান উপদেষ্টা হন। তাদের ব্যাপারে তো বিতর্ক ছিল না। পরে যখন সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার প্রসঙ্গ এল, তখন আওয়ামী লীগ আপত্তি করল।’

তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে এখন যদি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি)। তার ব্যাপারে আপত্তি আসবে বোঝাই যাচ্ছে। সব মিলে কথা হচ্ছে, যতদিন না দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ বন্ধ হবে, ততদিন পর্যন্ত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা উচিত হবে না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প ভাবা উচিত।’

প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়। ওই সংশোধনীতে বলা হয়, কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে কিংবা সংসদের মেয়াদের অবসান হলে এর ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। তবে সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা ছিল না। কেবল বলা ছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত এ সরকার ক্ষমতায় থাকবে। পরে দেখা যায়, সেনা-সমর্থিত বিগত ওয়ান ইলেভেন সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা ছিল তখন। সেই হিসাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন মনে করা হতো।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না গেলে বা তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানালে ঠিক তার অব্যবহিত পূর্বের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে।

এতে আরও বলা হয়, অবসরপ্রাপ্ত কোনো প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না গেলে আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং তাকে পাওয়া না গেলে বা তিনি সম্মত না হলে রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শক্রমে অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এসব বিকল্পের কোনোটিই কার্যকর করা না গেলে রাষ্ট্রপতি তার স্বীয় দায়িত্বের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করবেন।এই সর্বশেষ বিকল্প অনুসরণ করেই ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার কাছেই নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ছিল বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। দুই বছর পর ১৯৯৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। পরের বছর ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো একযোগে সংসদ বর্জন করে। এরই মধ্যে ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন হয়। এতে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হন। ওই উপনির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপি অভিযোগ তোলে বিরোধী দলগুলো। একে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন তীব্র হয়।

ওই বছরের মাঝামাঝিতে ১৯৯৪ সালের ২৪ জুন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা দেয়। বিএনপি সরকার তা আমলে না নিলে ২৮ ডিসেম্বর বিরোধীদলীয় ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। যদিও তাদের পদত্যাগ গ্রহণযোগ্য নয় বলে তখন রুলিং দেন স্পিকার। পরের বছর ১৯৯৫ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা সংসদে টানা ৯০ দিন অনুপস্থিত থাকেন। এর ফলে তাদের আসন শূন্য হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সুপ্রিম কোর্ট আসন শূন্য হওয়ার পক্ষে মতামত দেন।

পরে ১৭ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) শূন্য আসনগুলোতে ১৫ ডিসেম্বর উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করে। যদিও বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার উপনির্বাচনের পরিকল্পনা বাদ দেয়।

এমন অবস্থায় ওই বছরের ২৪ নভেম্বর সংসদ ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা আসে। নির্বাচনের তারিখ দেওয়া হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তবে আওয়ামী লীগসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে।

একতরফা ওই জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ২৭৮টি আসন পায়, যার মধ্যে ৪০ জনের বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই মাসের শেষ দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো হরতাল ও অসহযোগের মতো আন্দোলন চালাতে থাকে। পরে ১৯ মার্চ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয় এবং ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। ২৬ মার্চ গভীর রাতে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংসদ ভেঙে দেন। একই দিন তিনি নিজেও পদত্যাগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস দেশের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। তার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ওই সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়। ওই নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

পরে ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। ওই নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে বিএনপি-জামায়াত জোট। বিরোধী দলে যাওয়া আওয়ামী লীগ একে ‘নীল নকশা’র নির্বাচন বললেও গণমাধ্যম এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা একে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে অভিহিত করেন।

বিএনপির আমলে ২০০৪ সালের ১৬ মে সংসদে চতুর্দশ সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসর নেওয়ার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়। যার ফলে সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পথ সৃষ্টি হয়। বিচারপতি হওয়ার আগে যিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং দলটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগও সাফ জানিয়ে দেয় যে, তারা কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মানবে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের কারণে তখন দেশজুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাজনৈতিক সহিংসতায় তখন বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। পরদিন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের সব বিকল্প এড়িয়ে সর্বশেষ বিকল্প ধরে নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। একাধারে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের এমন সিদ্ধান্তে বিএনপির প্রতি তার পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনে আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং ইয়াজউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন।

প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর নির্বাচন দেয় এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই নির্বাচনও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ওই নির্বাচনে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে ২০১১ সালে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানে সংশোধনী আনে। তবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের যে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, সেই সংশোধনী বাতিল চেয়ে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদনটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন আছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এরপর ওই বছরের ৩০ জুন সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়।

এর আগে ওই বছরের ২৪ মার্চ বিশেষ কমিটির বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয় এবং বৈঠক শেষে এ-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘মিডনাইট ল’ বলে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন, ‘একটা বিতর্কিত সংসদে কোনো দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই বিএনপি একা একা মধ্যরাতে এই বিল পাস করেছে। এ নিয়ে কারও কোনো কথা বলার সুযোগ ছিল না। এখন আমাদের কাছে বিষয়টা এসেছে। এটা খুবই জটিল। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছি।’

এদিকে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে বিশেষ কমিটি। ওই দিন বিশেষ কমিটি সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে কোনো বিচারপতিকে নিয়োগ না দেওয়ার বিধান রেখে সংবিধান সংশোধনের পরামর্শ দেন। তাদের অভিমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়াটা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এ বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন।

বর্তমানেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিচারপতিদের যুক্ত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলে সেই আগের পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়ে ফেরার আশঙ্কা রয়েছে।

উল্লেখ্য, ওই বৈঠকের দুই দিন পর ২৭ এপ্রিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করে বিশেষ কমিটি। সে বৈঠকের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাতিল এবং আগের সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে বলে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। একই সঙ্গে সম্ভব হলে বিচার বিভাগের বাইরে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিধান করার পক্ষেও মত দিয়েছি।’

আওয়ামী লীগের প্রস্তাব ছিল, সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নির্বাচিত হবেন। অথবা সরকারি ও বিরোধী দলের পাঁচজন করে সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটিই ঠিক করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও অন্য উপদেষ্টা কারা হবেন।

তবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ইস্যুতে যখন বিশেষ কমিটির এসব বৈঠক চলছিল, এরই মধ্যে ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।

উল্লেখ্য এই মামলার শুনানিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সুপ্রিম কোর্টের আট জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। তাদের মধ্যে পাঁচ জন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তারা হলেন – ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যার্টনি জেনারেল মাহামুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে আরেক অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন। এছাড়া ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দেন আদালতে।

তবে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা হলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

১৬ মে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠক শেষে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, সংবিধান সংশোধন বিষয়ে তারা যে প্রতিবেদন সংসদে পেশ করবেন, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হবে।

পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সিদ্ধান্তটি হয় ৩০ মে অনুষ্ঠিত বিশেষ কমিটির বৈঠকে। তবে কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সদস্যদের অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আদালতের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক আরও দুই মেয়াদ রাখার পক্ষে জোর মত দিলেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আদালত অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। একটি অবৈধ সরকারব্যবস্থার অধীনে আর কোনো জাতীয় নির্বাচন নয়। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান না রেখেই সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য বলেন। এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কমিটির সদস্যদের তর্ক-বিতর্ক হয় বলেও কোনো কোনো সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন।

পরে ২০১১ সালের ৮ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করে এ বিষয়ে আলোচনার পথ উন্মুক্ত রেখে সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটির প্রতিবেদন সংসদে পেশ করা হয়।

সর্বশেষ ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেওয়া হলেও এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয় ৩ জুলাই। কিন্তু তার আগেই ৩০ জুন আপিল বিভাগের রায়ের ওপর ভিত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় বিগত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। ওই তিনটি নির্বাচনে মধ্যে একটিতে অংশ নিলেও অন্য দুটি বর্জন করে বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী দল। তিনটি নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় জনমনে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়।

Sharing is caring!