![](https://www.agamiprojonmo.net/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
প্রজন্ম ডেস্ক:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি সাত কলেজের সংঘাতের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিও বড় কারণ। কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্তির ফলে সংকট-সমস্যার অন্ত ছিল না। পেশিশক্তি প্রদর্শনের চেষ্টাসহ দায়িত্বশীল আচরণের অভাবে সমস্যা প্রকট হয়েছে। অধিভুক্তি বাতিলের দাবি মানার পরও ঢাবির উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) পদত্যাগ চেয়ে আলটিমেটাম দিয়েছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। দাবি না মানলে থানা ঘেরাও এবং ঢাবির বাস চলতে না দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে অধিভুক্তি বাতিলেও দ্রুতই সমাধান দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার নানা অসংগতি নিয়ে সরব থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমান। এই সংঘাতের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব নিয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রকাঠামো এবং সমাজ কাঠামোতে একধরনের পেশিশক্তির প্রভাব দেখি বা ডোমিনেশন দেখি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এর প্রভাব পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘এই জেনারেশনটা এমনিতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অস্থির। এ রকম ৫ আগস্টের পরে হচ্ছে তা নয়। জন্মের পর থেকেই তারা অনেক বেশি ডিভাইস ব্যবহার করে। এই জেনারেশনের পালস বোঝা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবকদের দায়িত্ব। এই ভিন্নতাকে আমাদের বুঝতে হবে, সেই অনুয়ায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। সবাই আমাদের দেশের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উঁচু, অন্যরা নিচু এই মানসিকতা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দাবির ডামাডোলে সাত কলেজ নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ নিয়ে সরকার একটা কমিটি গঠন করে গত অক্টোবরে। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সংশ্লিষ্টদেরও রাখা হয়।
সাত কলেজের আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম ফায়েজ বলেন, ‘আমরা হুট করে কিছু বলতে পারি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কলেজগুলোর অধ্যক্ষের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটার বাস্তবায়ন এবং এটাকে সরকার কীভাবে দেখছে, তা চিন্তাভাবনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ইচ্ছায় সাত কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দ্বন্দ্বও কাজ করেছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। অধিভুক্ত হওয়া সাত কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়াই প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীর তত্ত্বাবধান করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা অধিভুক্তির বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে শুরু থেকেই দুই পক্ষই নারাজ ছিল। শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে চলমান শিক্ষার্থীদের তথ্য দিতেও গড়িমসি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে ওয়েবসাইট তৈরি, অফিস কক্ষ ও জনবল নিয়োগ করে। সমস্যাগুলো পর্যায়ক্রমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অধিভুক্তি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজমান ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয় দেওয়া না দেওয়া, সার্টিফিকেট স্বতন্ত্র করা, অধিভুক্ত শব্দ বাদ দেওয়া, পরিবহন ব্যবহারসহ নানা ইস্যুতে মতবিরোধ ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এরই মধ্যে আন্দোলন কর্মসূচি চলে দুই পক্ষের মধ্যেই। ২০১৯ সালে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে তীব্র আন্দোলন করলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ হামলা করে। এরপর আর জোরালো কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাত কলেজের অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। বর্তমানে যেটা হচ্ছে সেটা ইগোর কারণে। কারণ অধিভুক্তের পর থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন ও খাতার মূল্যায়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা করেন। এ নিয়ে অসন্তোষ ছিল জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, বিসিএস দিয়ে আসা সাত কলেজের শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধীনে কাজ করতে চান না। আবার নিজেরা ক্লাস নিলেও পরীক্ষার প্রশ্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এতে তাদের আর্থিক সুবিধাও কমে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের পোস্ট দেখলেও বিষয়টি বোঝা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের একাধিক ফেসবুক গ্রুপে দেখা যায়, দুই পক্ষই অসংযত আচরণ করছে। কে সেরা তা মারামারি করে প্রমাণ করতে চান। অনেকে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে রাস্তায় নামার জন্য শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ নিয়েও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের বাইক প্রবেশ করতে না দিলে তারা ঢাবির বাস আটকে দেওয়ার হুমকি দেন। রাস্তা উন্মুক্ত করার দাবি জানান। এ ধরনের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দুই পক্ষই দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। একই সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টিতে রাজনৈতিক পক্ষের ইন্ধনের কথাও বলছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আমরা সমস্যার মূলে যেতে চাই না। কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করা হয়েছিল। সরকারের নির্দেশের বাইরে কথা বলার সামর্থ্য ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রস্তুতি ছাড়া অধিভুক্তের কারণে সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও ভুগতে হয়েছে। পুরো জিনিসটা অপরিকল্পিত। এ রকম সমস্যা হবে সেটা বোঝা গিয়েছিল। এখানে শিক্ষক কারা হবেন, কারিকুলাম কী হবে, মূল্যায়ন পদ্ধতি, ল্যাব সুবিধা, শিক্ষকদের মান উন্নয়নে প্রশিক্ষণসহ সেভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, শুধু ভর্তির মানদণ্ড নির্ধারণ করলে হবে না। সাত কলেজের সব বিষয়কে নিয়ে প্রো-ভিসির তত্ত্বাবধানে আলাদা একটা সেল করা দরকার ছিল। কিন্তু সে রকম কিছুই হয়নি। হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কোনো গবেষণা করা হয়নি। এত বছর পরও কেন সমাধান করা গেল না। অধিভুক্তি পৃথকীকরণে সাময়িক ক্ষোভ প্রশমন হলেও এখনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। তিক্ততার সঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয় না। এটার একটা রোডম্যাপ করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা দরকার ছিল।
Sharing is caring!