প্রজন্ম ডেস্ক:
বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সাল একই সঙ্গে ঘটনাবহুল এবং ভুল বা অপতথ্য ছড়ানোরও বছর। যদিও নির্বাচনি প্রচারণা ও উত্তেজনার কারণে ২০২৩ সালেও অপতথ্য ছড়িয়েছিল বহুগুণ। কিন্তু বিগত বছরটি তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেক ডেটাবেসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা ফ্যাক্টচেকারেরা ২৩ সালের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি ভুয়া তথ্য যাচাই করেছেন।
ডিসমিসল্যাব প্রতি বছর অপতথ্যের প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণ তৈরি করে থাকে। তারা জানিয়েছে, গত বছর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অপতথ্য ছিল রাজনৈতিক। এর কারণ, শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, মাঝামাঝিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেষ দিকে ধর্মীয় সংঘাত। ভুল তথ্যের বিষয় হিসেবে রাজনীতির পরেই ছিল ধর্ম। বছরের শেষ দিকে, অর্থাৎ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরের মাসগুলোতে ধর্ম সংশ্লিষ্ট ভুল তথ্য বেশি ছড়িয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে গ্রেফতার ও তার বিচারের ঘটনাগুলো এতে সবচেয়ে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে। আর আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত ভুল তথ্যের একটি বড় অংশ ছড়িয়েছে ইসরাইল-ইরান এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে কেন্দ্র করে।
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দেশ-এই তিনভাগে ভাগ করে দেখা গেছে ব্যক্তি হিসেবে শীর্ষে ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছিল আওয়ামী লীগ, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও বিএনপি নিয়ে। আর বাংলাদেশের বাইরে ভুল তথ্যের বিষয়বস্তু হিসেবে সবচেয়ে ওপরে ছিল ভারত এবং তারপরে ফিলিস্তিন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের মতো ২০২৪ সালেও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি (৩৯ শতাংশ) ভুল তথ্য ছড়িয়েছে শুধু ভিডিওর মাধ্যমে। এরপরেই ছিল ছবি (২৮ শতাংশ) ও গ্রাফিক কার্ডের (১৪ শতাংশ) ব্যবহার।
ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকিং ডেটাবেস অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা আটটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা, ২০২৪ সালে সাড়ে চার হাজারের বেশি ভুয়া তথ্য যাচাই করেছে। অনেক সময় একাধিক সংস্থা একই বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। সেখান থেকে একটিকে ইউনিক বা স্বতন্ত্র উপাত্ত হিসেবে দেখা যায়, ২০২৪ সালে তারা বাংলাদেশে ছড়ানো তিন হাজারের বেশি স্বতন্ত্র ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্ত ও যাচাই করেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
রাজনীতি ও ধর্ম বছরজুড়ে কমবেশি অপতথ্যের বিষয় ছিল। মোট ভুল তথ্যের তিন ভাগের এক ভাগই ছিল রাজনীতি সংক্রান্ত। এরপরেই রয়েছে ধর্ম ও খেলাধুলা। জুলাইয়ের শেষে এবং আগস্টের প্রথম ভাগে ভুল তথ্যের সংখ্যায় বড় উল্লম্ফন দেখা গেছে। এটি হয়েছে মূলত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময়ে রাজনৈতিক ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে। কোথাও পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি-ভিডিও দিয়ে আন্দোলনের তীব্রতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে, কোথাও আবার সাম্প্রতিক ছবি-ভিডিওকে পুরোনো দাবি করে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার ভাষ্য প্রচার করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ছড়ানো হয়েছে ভুয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বা সমর্থনের দাবিতেও প্রচারিত হতে দেখা গেছে নানা ভুল তথ্য। নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা ভুল দাবিও ভীতি ছড়িয়েছে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে।
একইভাবে গত বছরের জানুয়ারিতেও নির্বাচনের কারণে ভুল বা অপতথ্য ছড়িয়েছে। এই মাসে মোট অপতথ্যের ৪৮ শতাংশই ছিল রাজনৈতিক। নির্বাচনকে সফল দেখানো বা কারচুপি প্রমাণের চেষ্টা, নির্বাচনের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন অথবা সমালোচনা-একেক পক্ষ একেক ধরনের ভাষ্য তুলে ধরতে গিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। এ সময় অন্তত দুটি ক্ষেত্রে ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ভুয়া তথ্যও ছড়াতে দেখা গেছে। আর এই প্রার্থীদের দুজনই নারী।
গত বছর ধর্মীয় অপতথ্যের একটি বড় অংশে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বেড়েছে বা ইসলামি চরমপন্থার উত্থান হয়েছে। কোথাও পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি-ভিডিও দিয়ে হিন্দুদের ওপর হামলার ভুল দাবি করা হয়েছে, কোথাও মুসলিম ব্যক্তি বা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার দৃশ্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হিসেবে। কোথাও আবার ভুলভাবে বলা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিন্দুদের দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন,গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছেন বা বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে মিছিল করে হিন্দুদের জবাই করার হুমকি দিয়েছেন। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ধর্মবিষয়ক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব দেখেছিল, আগস্টের পর থেকে ধর্মীয় অপতথ্য কীভাবে ক্রমেই বিদ্বেষমূলক হয়ে উঠেছে, বিভাজন বাড়িয়েছে। আগস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য বেড়ে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয় নভেম্বরে ইসকন-চিন্ময় ইস্যুতে। গত বছর এপ্রিলেও ধর্ম সংক্রান্ত অপতথ্য বেড়েছিল।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিচারে তুলনামূলক নিস্তেজ মাস ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও জুনে সার্বিকভাবে ভুল তথ্যের পরিমাণ কম ছিল। আর এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ায় খেলাধুলা নিয়ে। ফেব্রুয়ারিতে মোট যাচাই প্রতিবেদনের ১৬ শতাংশই ছিল খেলাধুলা নিয়ে যা মার্চে আরও বেড়ে ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এ সময় ভুল তথ্যের মূল বিষয়বস্তু ছিল ক্রিকেট ও ক্রিকেট তারকারা।
আগস্টে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত ভুল তথ্য অন্যান্য মাসের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়, কারণ এই মাসের শেষে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। এ সময় ভারত, পাকিস্তান বা মেক্সিকোর বন্যার দৃশ্যকে প্রচার করা হয়েছে বাংলাদেশের বলে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি বেশ কয়েকটি ছবিও প্রচারিত হয়েছে বাংলাদেশের বন্যার দৃশ্য দাবিতে।
বছরজুড়ে যাদের ঘিরে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে-তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম এসেছে সবচেয়ে বেশিবার। এরপরই আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভুল তথ্যে এসব ব্যক্তিকে উপস্থাপন ছিল কখনো ইতিবাচক, কখনো নেতিবাচক। শেখ হাসিনা গোটা বছরই মিথ্যা তথ্যের বিষয়বস্তু ছিলেন, আর ড. ইউনূসকে নিয়ে অপপ্রচার শুরু হয় মূলত আগস্টে, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে। তাদের পরে, ভুল তথ্যের সবচেয়ে বড় মুখ ছিলেন বাংলাদেশের দুই তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আলোচনায় এসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
দেশের হিসেবে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের শিরোনামে সবচেয়ে বেশিবার এসেছে ভারতের নাম। ভারত প্রসঙ্গে ছড়ানো ভুল তথ্যের বিষয়বস্তু ছিল বহুমাত্রিক। তবে বছরের সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত বিষয় ছিল ৫ আগস্ট, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের অপপ্রচার। কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়ে ভুল ও অতিরঞ্জিত তথ্য, কখনো বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা- এ সময় উত্তেজনা ও বিভাজন ছড়িয়েছে।
২০২৪ সালে যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে ঘিরে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে তার শীর্ষে ছিল আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তারাই ছড়িয়েছে এসব ভুল তথ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এ সময় আন্দোলনকারীদের হামলায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নেতাকর্মীকে ছাত্রশিবিরের কর্মী দাবি করেও ছড়ানো হয়েছিল ভুল তথ্য।
৫ আগস্ট, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের পুরোনো মিছিল-সমাবেশের ছবি-ভিডিওকে প্রচার করা হয়েছিল সাম্প্রতিক দাবিতে।
আওয়ামী লীগের পর বেশি আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনী। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তার জেরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন-পরবর্তী সময়ে। এ সময় পুলিশের হামলায় আন্দোলনকারী নিহতের ভুল তথ্য যেমন ছড়িয়েছে তেমনি পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ভুল তথ্যও ছড়িয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য মারা গিয়েছিলেন বলে জানানো হয়েছিল পুলিশ সদর দফতর থেকে প্রকাশিত এক তালিকার মাধ্যমে। কিন্তু এই সংখ্যা হাজারেরও বেশি বলে প্রচারিত হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ৫০০ পুলিশ সদস্য হত্যার অভিযোগে মামলা করেছেন বলেও ছড়িয়েছিল ভুল তথ্য।
ভুল তথ্য ছড়ানো সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অন্যতম। এক্ষেত্রেও বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হতে দেখা গেছে জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সময়।
বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-কে নিয়েও বছরজুড়ে ছড়িয়েছে বিভিন্ন ভুল তথ্য। আর এসব মূলত ছড়িয়েছিলেন, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা।
Sharing is caring!