প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সংস্কার আর নির্বাচন ইস্যু। শুরু থেকেই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য সরকারের ওপর তৈরি হওয়া চাপ বর্তমানে বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। চাপের এই মাত্রা রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিস্তৃতি হয়েছে ক‚টনীতিতেও। দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক সম্পর্ক ছাড়াও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার সঙ্গে কূটনৈতিক লিয়াজোঁ অব্যাহত রাখার তাগিদে দ্রæত নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত দুই সময়সীমার মধ্যে প্রথমটি তথা চলতি বছরের ডিসেম্বরকে ঘিরেই সরকার পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। বিশ্লেষকদের মতে সরকারের এই মনোভাবে প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনেও। এরই মধ্যে ইসিও একাধিকবার জানিয়ে ডিসেম্বরকেই টার্গেট করে জাতীয় নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, জাতিসংঘসহ বিদেশি নানা সংস্থার সঙ্গে দেশের চলমান আন্তর্জাতিক অনেক চুক্তির মেয়াদ চলতি বছর শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে দুয়েকটি চুক্তি নবায়নে নির্বাচিত সরকারের অপরিহার্যতা সবচেয়ে বেশি। এমন একটি চুক্তির মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের ওপর জোর বাড়িয়েছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক দুই প্রভাবশালী দেশ ভারত, চীন এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মার্কিন নির্বাচনে জো বাইডেনের দলের পরাজয়ের পর থেকে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের আলোচনা বাড়ে। এর আগে বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের প্রতি বারবার ভারতের আগ্রহই বেশি দেখা গেছে। শেখ হাসিনা ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও ওয়াশিংটন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা করেছে বলে জানান ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি।
গত শনিবার কলকাতায় আমেরিকান সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটির বক্তব্যের দুদিন পর ভারতের সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা শুরু হয়। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি বলেছিলেন, বাংলাদেশে দ্রæত সময়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত আলোচনা করেছে। সম্প্রতি দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়, যেখানে বাংলাদেশে সম্ভাব্য নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এ ছাড়া আঞ্চলিক দুই প্রভাবশালী দেশ ভারত, চীনসহ আরও কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদেশিদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আগ্রহের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর মন্তব্যে। গত সোমবার দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্পর্ক নিয়ে নির্বাচিত সরকারের সময় কথা হওয়া উচিত। যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার মতো যথাযথ লোক নন তিনি।
এদিকে নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে বিএনপিসহ অংশীজনদের কী অবস্থান, তা জানতে ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বিএনপি ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন। একই সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনের রাষ্ট্রদূত। নির্বাচনে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশে কাজ শুরু করছে। ইউএনডিপির একটি প্রতিনিধি দল এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেছে। নির্বাচনে সহায়তা চেয়ে নির্বাচন কমিশন জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছিল, এটি জানিয়ে ঢাকায় সংস্থাটির আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে কী সহায়তা প্রয়োজন, তা মূল্যায়ন করা হবে। এ বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে ইউএনডিপি কী সহায়তা দিতে পারে, তা জানানো হবে। ফলে বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা চাপ বিদেশিদের পক্ষ থেকে তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে যে কোনো পরিস্থিতিতে পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন সেনাপ্রধান। সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।
তাকে বলা হয়, গত ১৫ বছরে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার, ব্যবসাসহ রাষ্ট্রের নানা ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। এটাকে একটি স্বাভাবিক জায়গায় আনতে তো সময় লাগবে।
এর জবাবে জেনারেল ওয়াকার বলেন, ‘এর জন্য রাজনৈতিক দল ও সরকার লাগবে। রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতি ও রাজনৈতিক সরকার ছাড়া এটা সম্ভব নয়।’
ডিসেম্বরে নির্বাচনের সমীকরণ মিল ইসির কার্যক্রমেও। সম্প্রতি নির্বাচন ভবনে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ইসির ১৪তম কমিশন সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, এখন আমাদের মূল ফোকাস হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। ইসি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের এক পরিপত্রে জানানো হয়, ২০ জানুয়ারি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সারা দেশে টানা দুই সপ্তাহ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারযোগ্যদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরই জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা থেকে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকার কাজ দ্রæত সম্পন্ন করে রাখতে চায়।
এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স এরই মধ্যে পাঁচ মাস পার হয়ে গেছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে না থাকা, দ্রব্যমূল্য, ট্যাক্স, বিনিয়োগে মন্দা, প্রশাসনে অস্থিরতা, পরাজিত শক্তির বিভিন্ন অপকৌশলÑএসব কারণে সরকারের ওপর দ্রæত নির্বাচন দেওয়ার চাপ প্রবল হয়ে উঠেছে।
একই কারণে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দল ও জনগণের নজিরবিহীন বিপুল সমর্থনকে উপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। নিজেদের আসল কাজে প্রয়োজনীয় মনোযোগ না দিয়ে তাদের বিভিন্ন দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে তারা খেই হারিয়ে ফেলছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে কালক্ষেপণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করলে ঝুঁকিতে পড়বে। এমনকি পথও হারাতে পারে বলে মনে করছেন রাষ্ট্রচিন্তকরা।
সংকট মোকাবিলায় দ্রুত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করছে রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবির সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলের নানামুখী চাপ বাড়ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা বারবার বলছি, নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এটা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেছেন, দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা হবে। বিএনপি ও জামায়াত নেতারাও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। বিএনপির পক্ষে বলা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জামায়াতের বক্তব্য, অতি জরুরি সংস্কারগুলো সাধন করে বর্তমান সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে যার যার জায়গায় চলে যায়।
সরকার চাইলে চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব বলে মনে করছে ছয়টি রাজনৈতিক দলের জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। সিপিবিও রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রæত নির্বাচনের দিকে যাবে বলে আশা করছে।
তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন মনে করে, কাক্সিক্ষত সংস্কার ছাড়া তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে আত্মঘাতী। এর মধ্য দিয়ে আগের ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরার পথ সুগম করবে। জাতীয় নাগরিক কমিটি বলেছে, তারাও দ্রæত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। কিন্তু সেটা হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন। বিএনপির নেতারা বলছেন, যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়ে গেছে, তাই সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পর থেকেই দেশ ও দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা দেখা দেয়। গত তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশিরভাগ দেশই সরকারের সংস্কার পদ্ধতির জোর সমর্থন দেয়। হাসিনা সরকারের দুর্নীতির তদন্ত বিষয়ে সরকারকে সমর্থন করে। তবে আন্তর্জাতিক মহল শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের কথা বলে আসছে।
Sharing is caring!