প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যুত্থান-পরবর্তী জনআকাঙ্ক্ষা

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ১৫, ২০২৪, ১২:১৭ অপরাহ্ণ
অভ্যুত্থান-পরবর্তী জনআকাঙ্ক্ষা

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ ঘটনাপ্রবাহ বড় হলে প্রত্যাশাও বড় হয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর, এমনকি উপমহাদেশের রাজনীতিতেও গত ৫ আগস্টের মতো এত বড় অভ্যুত্থান আর ঘটেনি। কোনো সরকারের বাড়াবাড়ি যে কত সীমাহীন হতে পারে, এর মূল্যও এখন আওয়ামী লীগ দিচ্ছে। প্রায় সব বিরোধী দলকে নির্মূল করে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে চেয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, বিগত সরকারের যেসব পদক্ষেপ বা বাড়াবাড়ির কারণে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, সে ধরনের বাড়াবাড়ি ভবিষ্যতে আর হবে কি না!

 

মহান সৃষ্টিকর্তা বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না। লুত জাতির সমকামিতা ও পাপাচারের কারণে জর্দান ও বায়তুল মোকাদ্দাসের মধ্যবর্তী অঞ্চলের ভূখণ্ডটিকে মহান আল্লাহতালা একেবারে ওপরে তুলে উল্টে দিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। লুত জাতির এই ধ্বংসস্থলটি এখন ডেড সি বা মৃত সাগর নামে পরিচিত। পবিত্র কোরআনের সুরা হিজরের ৭৪ নম্বর আয়াতে এ ঘটনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

 

২০০৯ সালের পর, গত সাড়ে ১৫ বছরে সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশের পরিস্থিতিও গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একেবারে উল্টে গেছে। দেশের পরিস্থিতি যে এভাবে উল্টে যাবে, এ কথা স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কেউ এক দিন আগে, এমনকি কয়েক ঘণ্টা আগেও বুঝতে পারেননি। এ কারণে অতিবিশ্বাসীদের এখন কেউ কেউ বলছেন যে, আল্লাহতালা হচ্ছেন সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী। কারণ টিকে থাকার জন্য শেখ হাসিনা সরকার সব ধরনের পরিকল্পনাই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো কাজে লাগেনি।

 

শেখ হাসিনা সরকার তথা আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। বিপরীতে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির উত্থান হয়েছে। আস্তে আস্তে এই উত্থান আরও বিস্তৃত হচ্ছে এবং হবে। এই উত্থান শুধু রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলোর ক্ষেত্রেই হয়নি, ছাত্র-সমাজ, নাগরিক সমাজসহ সাধারণ জনগণেরও উত্থান হয়েছে এবং তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

 

এর কারণ হলো, ব্যাপক উন্নয়নের কথা বলা হলেও দেশের মানুষ যে স্বস্তিতে ছিলেন না এবং তারা যে অতিষ্ঠ ছিলেন এ কথা হাসিনা সরকারের লোকরা বুঝতে সক্ষম হননি, বোঝার চেষ্টাও করেননি। তারা জনমতের বিপরীত স্রোতে চলেছেন। দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে কী কী কারণে কষ্টে আছেন, তারা সরকারের কোন কোন পদক্ষেপ পছন্দ করছেন না, কিংবা জুলুম-নির্যাতনে মানুষের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, হাসিনা সরকার সেসব বোঝার চেষ্টা না করে গায়ের জোরে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধু তাই নয়- রাষ্ট্র, সরকার বা সরকারসংশ্লিষ্ট অনেকের অন্যায় পদক্ষেপকে প্রভাবশালীরা ন্যায্যতা (জাস্টিফাই) দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বোঝার চেষ্টা করেননি যে, সমাজে যেটি অন্যায়, রাষ্ট্রে সেটিই অপরাধ এবং ধর্মে সেটিই পাপ।

 

অনেকের মতে, এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যায় ও অন্যায্য শাসনে অতিষ্ঠ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং তারাই একত্র হয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। অভ্যুত্থান এ কারণেই হয়েছে।

 

এখন অভ্যুত্থানের পরে একটি দেশে কী ঘটতে পারে বা জনগণইবা কী চায়, সেটি নিয়ে সুধী সমাজের লোক কথা বলা শুরু করেছেন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেছেন, অভ্যুত্থানের পরে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত জরুরি।

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের স্পিরিট কাজে লাগিয়ে পরিবর্তনের সূচনা এখন থেকেই করতে হবে।

 

রাজনীতির বড় অংশীজন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অভ্যুত্থানে অশুভ শক্তির পতন হলেও এখনো ষড়যন্ত্র চলছে।

 

গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের ‘শহিদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে যেকোনো মূল্যে দেশে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

 

মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায়, ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর দেশে আর কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। পর পর তিনটি নির্বাচনে অত্যন্ত ‘কূটকৌশল’ করে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে ক্ষমতায় বসেছে। এর ফলে মানুষ তার ভোটাধিকার হারিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যে বা যারাই ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কিংবা হাসিনা সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন, তাদেরকেই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে রাজাকার বলার চেষ্টা হয়েছে।

 

অনেকের মতে, এভাবেই দেশে কথিত রাজাকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই ‘রাজাকার’ শব্দই শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়ে সরকারের পতন ত্বরান্বিত করেছে।

 

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ, গণতান্ত্রিক দেশ ও সংবিধান, অন্যায় ও অবিচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলাই হলো দেশের জনগণের এই মুহূর্তের প্রত্যাশা; সেখানে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থাকবে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছ থেকে নিরাপদ রাখার অঙ্গীকার থাকতে হবে। বাংলাদেশের ওপরে কোনোক্রমেই ভারতের হস্তক্ষেপ মানা যাবে না।’

 

‘আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও যেসব কর্মকাণ্ডের ফলে সরকারের পতন হয়েছে, সেসব কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। পাশাপাশি যারা মানুষ হত্যা করেছে, গুম-খুন করেছে, তাদের বিচারের আওতায় এনে যথাযথভাবে যেন শাস্তি দেওয়া হয়’ যোগ করেন ড. মাহবুব উল্লাহ।

 

শিক্ষাবিদ ও চিন্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে, ‘দেশের মানুষ যে ভোট দিতে পারেনি সে আক্ষেপ তাদের রয়ে গেছে। ফলে সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচনের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভালো-মন্দ মিলিয়ে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছে। ফলে সেখান থেকে ভালোগুলো গ্রহণ করে মন্দকাজ পরিহার করলে জনগণ খুশি হবে। তবে সবার মনে রাখতে হবে, যেসব পদক্ষেপের কারণে জনগণ বিগত সরকারের ব্যাপারে রুষ্ট হয়েছিল, সেগুলোর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

 

সুধী সমাজের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের এখন মূল প্রত্যাশা হলো, গণ-অভ্যুত্থানের আগে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যা যা হয়েছে এখন যেন সেসব না ঘটে। পাশাপাশি শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ থাকার কারণ নির্ণয়ও জরুরি। বিশেষ করে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মনোযোগী হওয়া বেশি প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে, এমন আলোচনা এখন বেশ জোরেশোরে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে বিগত সরকারের শেষ দিকে মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। কিন্তু এখনো এই সমস্যার সমাধান হয়নি। উল্টো নিত্যপণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে। এটি নিয়ে জনমনে সমালোচনা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসন না থাকা এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণে দেশে-বিদেশে বিগত সরকার সবচেয়ে বেশি ভাবমূর্তিসংকটে পড়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কয়েক সপ্তায় বিচারবহির্ভূত দু-একটি ঘটনা ঘটলেও এখন তা কমে গেছে। তবে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করায় গুম-খুন বর্তমান বা ভবিষ্যৎ সরকারের সময়েও আর ফিরে আসবে না বলে মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ঠিক তার উল্টো কাজ করেছে। তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ এনে দেশে-বিদেশে সরকার ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। অথচ সরকার ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র এখন উঠে আসছে। দুই কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল, সেটি মানুষ গ্রহণ করেনি। ফলে জনগণ এখন দুর্নীতিমুক্ত দেশ চায়। ব্যাংক লুট ও বিদেশে টাকা পাচারের ঘটনা এখন জনমনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলেই মানুষ প্রত্যাশা করে। দলীয়করণের ফলে পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনসহ দেশের সব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এগুলো যেন আর কখনো দলীয়করণ করা না হয় এমন সংস্কার এখন সময়ের দাবি। চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের নাগরিকরা সমান সুবিধা লাভ করবে, এমনটিই প্রত্যাশা।

 

অভ্যুত্থান-পরবর্তী আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণ করা অনেকাংশে অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।

 

তিনি বলেন, ‘এটা কারও পক্ষে সম্পূর্ণ পূরণ করা সম্ভব নয়। যে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তা পূরণ করতে অতিমানব হওয়া দরকার। এখন একদল লোক প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও আমাদের বিতর্কিত করার জন্য ‍উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আমরা চলে গেলে সত্যি কথা বলার লোক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষের কল্যাণে কাজ করার লোকও পাওয়া যাবে না।’

 

বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, ‘তবে এটা ঠিক, যেসব অপকর্মের কারণে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে একই ধরনের কাজ আমরা বা পরবর্তী সরকারের কাছ থেকে জনগণ প্রত্যাশা করে না।’

Sharing is caring!