প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিপূর্ণভাবে স্থিতিশীল হয়নি। বরং নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংস্কার ও কোন নির্বাচন আগে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ মতবিরোধসহ বিভিন্ন কারণে রাজনীতিতে কিছুটা অস্থিরতা আছে। এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সর্বোপরি প্রশাসন ও পুলিশে এখনো স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। প্রশাসন বনাম বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে বিভক্তি অবসানের কোনো লক্ষণ নেই। অন্যদিকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণভাবে গতিশীল হয়নি। ফলে জনমনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এত সব সরকার সামাল দেবে কীভাবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। আমি মনে করি, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ দেওয়া উচিত হবে। না হলে রাজনৈতিক দলগুলো আবার রাস্তায় নামবে। এতে নতুন সমস্যার মুখে পড়তে হবে সরকারকে।
তিনি বলেন, আজ হোক বা কাল হোক নির্বাচন তো দিতেই হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেরিতে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মহলও নির্বাচন চাইছে। কারণ দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে। বিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই, সমঝোতাও হবে না। এ জন্য নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে দেরি হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে। ফলে দ্রুত নির্বাচন হলে দেশে সংকটও কমে আসবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো চিহ্নিত করে শুধু অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে ভোটের জন্য প্রস্তুতি, ভোটার তালিকা তৈরিসহ নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ দেওয়াই বর্তমান সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে, ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে, অন্যান্য আইনের সংস্কারকাজও চলমান। সংস্কার কমিশনে বিএনপি তাদের মতামত দিয়েছে। এই মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রধান উপদেষ্টা সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে কী কী সংস্কার করা যায় সে ব্যাপারে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেন। কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকবে, এটা স্বাভাবিক। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেগুলো সংস্কার হবে। এখানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চিহ্নিত করে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
তার মতে, ‘নির্বাচনের জন্য মাঠের ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সংস্কার দুই-তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব। আর নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এলে সংবিধান সংশোধনীসহ অন্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে। এর আগে জাতির কাছে তারা অঙ্গীকার এবং নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দেবে যে, আমরা আগামী দিনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগুলো বাস্তবায়ন করব।’ যেমন আদালতের রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও গণভোটের বিধান পুনর্বহাল হয়েছে। ফলে অন্য সমস্যাগুলোও সমাধানে পরবর্তী সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
জানা গেছে, সরকার ও বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলোর মধ্যে দূরত্বের মূল কারণ হলো নির্বাচনের সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা না করা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র বিনির্মাণে ঠিক কতটা সংস্কার হবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা- এসব ইস্যু নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাদের সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলে অনেকে ‘মাইনাস টু’ এর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে। যদিও বিএনপি বলছে, মাইনাস টু-এর আশা জীবনেও পূরণ হবে না।
ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরেই নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে এ ক্ষেত্রে অনেকটাই কৌশলী অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি ‘আগে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার ও পরে নির্বাচনে’র কথা বলছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা, রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে দ্বিমত, ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৭ বছর করার উদ্যোগ নিয়েও বিএনপির আপত্তি রয়েছে। পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নীরব মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় দখল ও চাঁদাবাজিসহ নানা ইস্যুতে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এখনো অব্যাহত আছে। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সর্বশেষ ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’ (ঘোষণাপত্র) তৈরি এবং সংবিধান বাতিলসংক্রান্ত বক্তব্য নিয়েও দ্বিমত স্পষ্ট হয়েছে। এখন ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নয়, গত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতি চায় বিএনপি। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরিতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র নেতৃত্বের নতুন দলকে স্বাগত জানালেও এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও মনে করে বিএনপিসহ তার মিত্ররা। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে সংস্কার হোক আর যাই হোক বিএনপির সমর্থন ছাড়া বা দলটির সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সরকারের কোনো কাজই সহজ হবে না বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, সব দলের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বিঘ্নে একটি নির্বাচন তথা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে জনগণ আশা করে অতীতের মতো কিংস পার্টি হবে না। সরকারের সহযোগিতায় কোনো রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে না। কোনো গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা ইস্যুতে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে বাহাসে লিপ্ত রয়েছে দল দুটির একাধিক নেতা। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে গণতন্ত্র মঞ্চেও অনৈক্যের সুর। এই ইস্যুতে জোট থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে গণসংহতি আন্দোলন ও রাষ্ট্র-সংস্কার আন্দোলন। দল দুটির প্রস্তাব- নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে এবং সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। একই প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংবিধান সংস্কার নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে সবাই শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। আগামী দিনেও অন্তর্বর্তী সরকার সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করব।’ তিনি বলেন, ‘দেশে দলও অনেক এবং মত ভিন্ন। তবে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকলেই হবে। রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা কোনো ব্যাপার নয়।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com