প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশের শ্রমজীবী মানুষের আর্থিক-সামাজিক সুরক্ষার চিত্র মোটেও সুখকর নয়। ন্যায্য মজুরি মিলছে না, বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কত হবে তার সঠিক কোনো মানদণ্ডও নেই। এসব শ্রমিকের সামাজিক স্বীকৃতি নেই, তারা রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষার আওতার মধ্যেও কখনো আসে না। বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যে জোটে না আইনি সুরক্ষাও। দেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ ভাগ বা প্রায় ৬ কোটি শ্রমিক প্রকৃত মজুরি মানদণ্ডের বাইরে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ধানমন্ডির কার্যালয়ে ‘শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ ও অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার উদ্যোগ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আলোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে।
এ বিষয়ে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, দেশের ৮৫ ভাগ বা প্রায় ছয় কোটি শ্রমিকের কোনো আইনি সুরক্ষা ও মজুরির মানদণ্ড নেই। তিনি বলেন, আমরা কমিশনের কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ৮৫ ভাগ শ্রমিক রয়েছে ইনফরমাল। ৮৫ ভাগ মানে হচ্ছে প্রায় ছয় কোটি শ্রমিক। তাদের কোনো সুরক্ষা নেই। ওই ৮৫ ভাগ নিয়ে কাজ করছি। তাদের আইনের সুরক্ষা, মজুরির মানদণ্ড ও সামাজিক স্বীকৃতিও নেই। আমরা আইন নিয়ে যত আলোচনা করছি তার মধ্যে রয়েছে মাত্র ৫ ভাগ। তিনি বলেন, গৃহশ্রমিক থেকে শুরু করে সচিবালয় শ্রমিকদের বিবেচনা করেন তা হলে দেখবেন বৈষম্য কতটা বেড়েছে। নির্মাণকাজে সরাসরি শ্রমিক দেখবেন না। যত শ্রমিক সব নিয়োগ দেয় ঠিকাদার, যাদের সরাসরি দেখতে পাবেন না। তা হলে তাদের অধিকার নিয়ে কীভাবে কাজ করবেন? সব মিলিয়ে আমরা খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সংস্কার করতে হবে, সে কারণে সবাইকে নিয়ে সুপারিশ তৈরি করতে চাই। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। শ্রমিক বেতন ও অধিকার পেতে কেন রাস্তায় নামতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীদেরও মানবাধিকার কেন থাকবে না, সেটিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সুপারিশ প্রণয়নই শেষ কাজ নয়, বাস্তবায়নে মাঠে থাকতে হবে।
আলোচনায় গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পরও যাতে কমিশনের কার্যক্রম কয়েক দিন অব্যাহত থাকে, সেটি আমাদের অনুরোধ থাকবে, যাতে তারা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তাদের নজরদারি রাখতে পারে। বাস্তবায়ন পর্যায়েও কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার পদক্ষেপ নেবে। কারণ কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেক গ্রুপের চাপ রয়েছে। যারা কমিশনের রিপোর্ট এড়িয়ে যেতে চাইবে কিংবা কম গুরুত্ব দেবে। সে কারণে অন্তর্বর্তী সরকার কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
অন্তর্বর্তী রিফর্ম সেল গঠনে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি আগামী এক বছর শ্রম কল্যাণ বছর হিসেবে ঘোষণা করে এবং সেই আলোকে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম সেভাবে বিন্যস্ত করে, তা হলে অন্তর্বর্তী কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সহজতর হবে। সেই আলোকে আমাদের সাজেশন থাকবে শ্রমিক সংক্রান্ত যতগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে, সেখানে অন্তর্বর্তী রিফর্ম সেল গঠন করা যায় কি না। সেই রিফর্ম সেল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মনিটরিং কাজগুলো করবে। রিফর্ম সেল গঠন করলে আমরা মনে করি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ইতিবাচক কাজ করবে। একই সঙ্গে আমরা মনে করি না যে, আমাদের উদ্যোক্তারা সব সুপারিশ বাস্তবায়নে এখনই প্রস্তুত। ফরমাল সেক্টরগুলোতে যারা রয়েছেন, তারা হয়তো প্রস্তুত থাকতে পারে; কিন্তু ইনফরমাল সেক্টরে যারা আছেন তারা প্রস্তুত নন।
শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য শ্রমিক নেতা মিস তাসলিমা আক্তার লিমা বলেন, শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে আমি মনে করি, জীবন, জীবিকা এবং জবানের অধিকার শ্রম সেক্টরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে জীবিকা এবং জবানের যে অধিকার সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আইনের বিভিন্ন দিক ধরে এবং চর্চার বিভিন্ন দিক সিপিডি উত্থাপন করেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে শ্রম শক্তির গুরুত্ব ও শ্রম শক্তির মর্যাদা সেটিকে সামনে রেখে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের কাজকে সাধারণত ছোট কাজ মনে করেন। আমরা সমাজের মধ্যে আমাদের ঘরে-বাইরে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা দেখি শ্রমিকদের ‘তুই’ সম্বোধন করি। যেটি অপমানকর।
তিনি বলেন, শ্রম আদালত থেকে শুরু করে হাইকোর্ট পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় আমরা দেখি আইনের বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার থাকলেও আপিলাত ডিভিশন থেকে শুরু করে হাইকোর্টে পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। যেটি শ্রমিকদের বোধগম্য নয়। শ্রমিকদের বোঝার জন্য বাংলা ভাষার সহজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। সংবিধান শ্রমিকের অধিকার দিলেও আইনের মারপ্যাঁচে আটকে আছে।
মজুরি বীমা এবং শিশুশিক্ষা ভাতা চালুর সুপারিশ সিপিডির : ‘শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ ও অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার উদ্যোগ : অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এ আলোচনা সভায় সিপিডি সরকারকে একটি ওয়েজ গ্যারান্টি বীমা স্কিম চালু করার সুপারিশ করেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে কিছু ছিল দীর্ঘমেয়াদি, কিছু মধ্যমেয়াদি এবং কিছু ছিল স্বল্পমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদে সিপিডি ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে শিশুশিক্ষা ভাতা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে।
সিপিডি জাতীয় পর্যায়ে ধীরে ধীরে একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করার সুপারিশ করেছে, যা সব শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক খাত এবং যেসব খাত এখনও ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বিধিমালার আওতায় আসেনি সেগুলোতে কার্যকর হবে।
মধ্যমেয়াদি সুপারিশ হিসেবে সিপিডি আগামী এক বছরের মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি আগে নির্ধারিত সব খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরির বড় ধরনের সংস্কারের সুপারিশ করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে সবচেয়ে পুরোনোগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেসব চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক; বিশেষ করে যারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সাময়িকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি আইনগতভাবে নিশ্চিত করা উচিত। সব ধরনের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ভাতা (যেমন আবাসন ভাতা) নির্দিষ্ট পরিমাণের পরিবর্তে মূল বেতনের শতাংশ হিসেবে নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ হিসেবে সিপিডি বলেছে, সব শিল্পকে এমডব্লিউবি কাভারেজের আওতায় আনা উচিত এবং যেখানে ট্রেড ইউনিয়নের উপস্থিতি কম সেগুলোতে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑমজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি দিনের বিলম্বের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে একটি নতুন আইনি বিধান চালু করা। বিশেষত ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার বারবার ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার জন্য জরিমানা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো।
সিপিডি আরও যেসব সুপারিশ করেছে তার মধ্যে আছে-অতিরিক্ত সময়ে কাজের জন্য বেতন না দেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইনের আওতায় আনা উচিত এবং ন্যূনতম মজুরি ও বেতন সংক্রান্ত জাতীয় বিধিবিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড/ক্রেতাদের জবাবদিহি করা উচিত।
পাশাপাশি সিপিডি প্রস্তাব করেছে, শ্রম অধিদফতরকে নতুন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পর চার মাসের মধ্যে একটি বেতন বাস্তবায়ন মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ম অনুসরণ করছে না, তাদের নাম প্রকাশ্যে প্রকাশ করতে হবে। এ ছাড়া একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি দিবস ঘোষণা করা উচিত এবং প্রতি বছর এটি উদযাপন করা উচিত, যাতে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
বেতন পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সিপিডি প্রস্তাব করেছে-বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা অবশ্যই আনুষ্ঠানিক এবং ব্যাংকিং চ্যানেল এবং/অথবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)/ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (ডিএফএস) মাধ্যমে দেওয়া উচিত এবং শিল্পাঞ্চলের কাছাকাছি শ্রমিকদের জন্য নাইট ব্যাংকিং সেবা চালু করা উচিত বলেও মত দেওয়া হয়।
শ্রম সংস্কার কমিশনের অনুসন্ধানে যা মিলেছে :
শ্রম আইন সংশোধন ও শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি এবং শ্রমিকদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় দেশের শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে গত নভেম্বরে। কমিশনের আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সুপারিশ ও প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কমিশনের অনুসন্ধানে কেমন চিত্র উঠে এসেছে=এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় মূলত সেক্টরভিত্তিক। অথচ সরকার গঠিত ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের আওতায় এই সেক্টরভিত্তিক মজুরি পাওয়া শ্রমিকের হার মাত্র ১৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশ শ্রমিক কিন্তু এখনও ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর বাইরে রয়েছে। এসব শ্রমিকের আসলে প্রকৃত মজুরি কত পাওয়া দরকার সেটিরই কোনো মানদণ্ড নেই। এমনিতেই যেসব সেক্টরের জন্য মজুরি কাঠামো রয়েছে, সেসব খাতের শ্রমিকরাও প্রকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত। আর যেসব খাতের শ্রমিকের জন্য কোনো মজুরি কাঠামোই নেই, তারা প্রকৃত মজুরি থেকে আরও বেশি বঞ্চিত। দেশের মাত্র ৪২-৪৩টি খাতের শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো গঠন করা আছে; কিন্তু এ খাতগুলোর শ্রমিকের সংখ্যা দেশের মোট শ্রমিকের সংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে কৃষি খাতে। তাদের জন্য কোনো মজুরি কাঠামো নেই। এ ছাড়া দিনমজুর, গৃহ শ্রমিকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য কোনো ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নেই।
সরকার যে মজুরি কমিশন গঠন করে দিয়েছে, সে কমিশন শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী করণীয় তা ঠিক করতে কাজ শুরু করেছে। এ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্বে আছেন সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, শ্রম সংক্রান্ত কমিশন গঠন হয়েছে অন্যান্য কমিশনগুলো গঠন হওয়ার অনেক পরে, শেষের দিকে। এ কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময়সীমা রয়েছে আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি। আমরা আশা করছি তার আগেই অর্থাৎ আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে পারব।’
সুলতান উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘এখনও আমরা সব পক্ষের মতামত গ্রহণ করছি। সবার সঙ্গে কথা বলা শেষে আমরা আমাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করব। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে শ্রম খাতের বড় যেসব অসঙ্গতি ধরা পড়েছে তার মধ্যে আছেÑশ্রম খাতের জন্য কেন্দ্রীয় কোনো ডাটাবেজ নেই, দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শ্রমিকদের কোনো অংশগ্রহণ নেই, শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তার কোনো কাঠামো নেইÑএসব বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। তবে আমাদের প্রস্তাবে আউটসোর্সিং শ্রমিক, গৃহ শ্রমিক, মৎস্য শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে বেশি ফোকাস থাকবে।’
Sharing is caring!