প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। প্রথমে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। এরপর সীমিত আকারে চিকিৎসা ও জরুরি বিষয়ে ভিসা চালু করলেও তার সংখ্যা খুবই কম। গত ছয় মাসে বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্ক গত ৫৩ বছরের মধ্যে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
যদিও দুই দেশের সরকার পক্ষই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা বলে আসছে। এমনকি শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার যে বিরাগ ছিল সেটিও কমেছে। দেশটিতে বসে শেখ হাসিনা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে না পারেন সে বিষয়ে প্রবল আপত্তির কথা ঢাকার পক্ষ থেকে জোরালোভাবে জানানো হয়েছে দিল্লিকে। গত মাসে বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কিন্তু এরপরও কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এরই মধ্যে হঠাৎ করেই সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি কিছু কিছু জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে চাইছে ভারত। ফলে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের মাথায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক কোন দিকে এগোচ্ছে। তবে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং গত এক মাসের বিভিন্ন আলোচনায় মনে হয়েছে, খানিকটা সহজ হয়ে আসছে সম্পর্ক। হঠাৎ গত এক সপ্তাহে সীমান্তে নজরদারি ও কাঁটাতারের বেড়া ইস্যুতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।
ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারত সীমান্তে নজরদারি আরও শক্তিশালী করার জন্য সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে, নাইট ভিশন ক্যামেরা ও মুভমেন্ট ডিটেক্টর যা নিরাপত্তার দিক থেকে বিএসএফের কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করেছে। এ ছাড়া সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত।
স্থানীয়রা জানায়, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সীমান্তের শূন্যরেখার মধ্যে আইন লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে বিএসএফ। এ নিয়ে বিএসএফ ও বিজিবি সীমান্তে অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করায় উত্তেজনা তৈরি হয়। গত শুক্রবার সকালে সীমান্তের প্রায় অর্ধকিলোমিটারের মধ্যে বিএসএফ ভারতীয় ৩০-৩৫ জন নির্মাণশ্রমিককে দিয়ে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি খুঁটির মধ্যে প্রায় চার ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করে। শূন্যরেখার দেড়শ গজের শেষ অংশে স্থানীয়রা এসব স্থাপন করতে দেখে বিজিবিকে খবর দেয়। এরপর ৫১ রংপুর বিজিবি ব্যাটালিয়নের পানবাড়ি ও দহগ্রাম ক্যাম্পের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বেড়া স্থাপনে বাধা দেন। এতে কিছু সময় নির্মাণকাজ বন্ধ রাখেন বিএসএফ সদস্যরা। পরে কয়েকশ বিএসএফ সদস্য এবং লোকজন নিয়ে আবারও বেড়া স্থাপনের কাজ করতে থাকেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সীমান্তে অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করেছে বিএসএফ। গোটা দহগ্রাম ইউনিয়ন সীমান্তে বিজিবিকেও সতর্ক অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনার আগেই সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, ভারতের এমন পদক্ষেপের পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার দীর্ঘ ইতিহাস, যেমন ফেলানী হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় বাহিনীর কার্যকলাপ এবং সীমান্তে নতুন পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারলে ভালো। কারণ ভারত একতরফাভাবে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। না হয় সীমান্তে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আরও অধিক আলোচনা এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। যাতে ভবিষ্যতে সীমান্তে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখা যায়।
এদিকে ভারত নিরাপত্তা ইস্যু সামনে এনে দুই দেশের জল ও স্থলসীমাসংলগ্ন এলাকা থেকে ১৫০ মিটার দূরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও করেছে। দেশটির উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দুটি অঞ্চলে সীমান্ত প্রহরায় নতুন বেশ কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএসএফ। এ অঞ্চল দুটির একটির বিপরীতে আছে বাংলাদেশের যশোর, আরেকটির উল্টোদিকে সাতক্ষীরা জেলা।
বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের প্রায় ৩৬৩ কিলোমিটার নদী সীমান্ত। ফ্রন্টিয়ারের ৯০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকার মধ্যে প্রায় ৪০০ কিলোমিটারে চিরাচরিত কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া গেছে, বাকি প্রায় অর্ধেক এলাকায় এখনো কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে বিএসএফের বরাত দিয়ে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ এলাকায় বেশ কিছু অরক্ষিত বা ভালনারেবল (ঝুঁকিপূর্ণ) জায়গা চিহ্নিত করেছে বিএসএফ, যেগুলো দিয়ে সীমান্ত-অপরাধ হচ্ছে। চিহ্নিত জায়গাগুলোতে প্রহরীরা তো থাকবেনই আগের মতো, তার সঙ্গে সমন্বিত একগুচ্ছ অন্য ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
ভারতের গণমাধ্যম বলছে, নতুন সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় একসারি কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হবে এবং একই সঙ্গে নজরদারির জন্য একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সঙ্গে প্রহরীদের সতর্ক করার জন্যও কিছু যন্ত্র লাগানো হয়েছে। নতুন এই সমন্বিত ব্যবস্থাপনাকে বিএসএফ বলছে, ‘ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স অ্যাট ভালনারাবেল প্যাচেস ইএসভিপি’ বা ‘অসুরক্ষিত এলাকাগুলোর জন্য বৈদ্যুতিক নজরদারি’ ব্যবস্থা। আবার সীমান্ত লাগোয়া ১৫০ মিটার বসতি খালি করে দিয়ে সেখানকার মানুষদের অন্যত্র জমি দেওয়ার জন্য আলোচনাও চলছে। সীমান্ত লাগোয়া এলাকা খালি করে দেওয়ার পরেই সেখানে ইএসভিপি ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে।
তবে আপাতত লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্তে উত্তেজনা নিরসনে বিএসএফ শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বিজিবির রংপুর ৫১ ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক (এডি) আমীর খসরু এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, শুক্রবার সকাল থেকে বিজিবিকে কোনো কিছু না জানিয়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ শুরু করে বিএসএফ। সকাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত প্রধান পিলার ডিএমপি ৮ নম্বরের উপ-পিলার ৪৬ থেকে ৩৭ নম্বর সীমান্তের প্রায় অর্ধকিলোমিটারের মধ্যে বিএসএফ ভারতীয় ৩০ থেকে ৩৫ জন নির্মাণশ্রমিককে দিয়ে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি খুঁটির মধ্যে প্রায় চার ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করে। শূন্যরেখার দেড়শ গজের শেষ অংশে স্থানীয়রা এসব স্থাপনা করতে দেখে বিজিবিকে খবর দেয়। বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের পানবাড়ি ও দহগ্রাম ক্যাম্পের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বেড়া স্থাপনে বাধা দেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সীমান্তে বিএসএফের অসংখ্য সদস্য মোতায়েন করে ভারত। সীমান্তে বিজিবিকেও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভারতের কোচবিহারের ৬ রাণীনগর বিএসএফ ব্যাটালিয়নের করুণ ক্যাম্পের সদস্যরা আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন না মেনে শূন্যরেখার ১৫০ গজের একদম শেষ অংশে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করেছিলেন।
বিজিবি রংপুর ৫১ ব্যাটালিয়নের এডি আমীর খসরু বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ঘটনায় চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আমরা এখনো উপনীত হতে পারিনি। গতকাল (শুক্রবার) বিএসএফের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছিল। আমরা জনবল বৃদ্ধি করেছি। বিএসএফ কাজ বন্ধ রেখেছে। বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে। বিজিবি সীমান্তে শক্ত অবস্থানে আছে।
এর আগে একই জায়গায় গত বছরের আগস্টে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করে। গত ৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তেও একই ঘটনা ঘটে। দুদিন পর বেড়া নির্মাণকাজ বন্ধ করে বিএসএফ। সে সময়ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
একইভাবে গত ৬ জানুয়ারি নওগাঁর ধামুইধা সীমান্তেও একই ঘটনা ঘটে। সে দিনই ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা গোদলা নদীর পাঁচ কিলোমিটার এলাকা দখলমুক্ত করার দাবি করে বিজিবি। পরে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বিএসএফ বিজিবির দাবি নাকচ করেছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, পূর্ব আলোচনা ছাড়া সীমান্তে কোনো দেশের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আন্তর্জাতিক সীমানা আইনের লঙ্ঘন। এ আইন অনুসারে সীমান্তের নো-ম্যান্সল্যান্ডের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থাপনা বা বেড়া নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু বিএসএফ সেটি না মেনে সীমান্তের ১০-১২ গজের মধ্যে কাজ শুরু করলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
তবে বিএসএফ এ প্রসঙ্গে বলেছে, ২০১০ সালের চুক্তি অনুযায়ী আঙ্গুরপোতা দহগ্রাম এলাকায় শূন্যরেখা বরাবর তারা এক সারি কাঁটাতার দিতে পারবে। বিজিবি বলছে, ২০২১ সালে তিনবিঘা করিডর দিয়ে আঙ্গুরপোতা দহগ্রাম এলাকায় অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপনকাজে বিএসএফ বাধা দেয়। সেটির এখনো কোনো সমাধান হয়নি। এমন উত্তেজনার মধ্যে গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবক আহত হন।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com