প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১০ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১০ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

এপ্রিলের আগে বই পাচ্ছে না সবাই

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ৯, ২০২৫, ১২:৩৭ অপরাহ্ণ
এপ্রিলের আগে বই পাচ্ছে না সবাই

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

২০ জানুয়ারির মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির সব বই ছাপানোর কাজে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ছাপাতে পেরেছে ২৭ শতাংশ। প্রেসগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করলে বাকি ৭৩ শতাংশ বই এ মাসের মধ্যেই ছাপানো সম্ভব বলে মনে করছে এনসিটিবি। কিন্তু বই ছাপানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এনসিটিবির এ সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। তারা বলছে, ছাপানো ও বাঁধাই শেষে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের হাতে এপ্রিলের আগে সব বই পৌঁছানো সম্ভব নয়।

ছাপানোর কাজ শেষ না হওয়ায় এ বছর বই উৎসবই হয়নি। বছরের শুরুর দিন ১ জানুয়ারি বই পৌঁছায়নি সব শিক্ষার্থীর হাতে। এখন পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বেশিরভাগ বই ছাপা হয়েছে এবং সেগুলো ইতিমধ্যেই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বছরের প্রথম দিন এই তিন শ্রেণির বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বই হাতে পেয়েছে। তবে বাকি সাত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বই ছাপা হয়েছে ৬ শতাংশ।

সব শিক্ষার্থী বই না পাওয়ায় স্কুলগুলোতে পাঠদান ঠিকমতো শুরু হয়নি। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে। শিক্ষকরা যে কয়েকটি বই হাতে পেয়েছেন, তা দিয়েই কোনোমতে চালাচ্ছেন পাঠদান। নামকরা স্কুলগুলো এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে কিছু বই ডাউনলোড করে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলেই শিক্ষার্থীরা শুধু যাওয়া-আসা ও খেলাধুলার মধ্যেই রয়েছে।

এ বছর সময়মতো বই ছাপানো কাজ শেষ না হওয়ার জন্য এনসিটিবি কর্র্তৃপক্ষ ছাপার দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর গাফিলতিকে দায়ী করছে। আর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এনসিটিবির পরিকল্পনার অভাবকে দুষছে।

এর আগে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এ বছর পাঠ্যবই ছাপার কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে বলে স্বীকার করেছেন। সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, গত সরকারের আমলে বই ছাপায় কিছু অসাধু চক্র গড়ে উঠেছিল। চক্রটি এবারও সক্রিয় ছিল। তারা শুরু থেকে অসহযোগিতা করেছে। এ কারণে বই ছাপানোর কাজে কিছুটা বিঘœ ঘটেছে। ভবিষ্যতে হয়তো এ সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যাবে, সরকার আশা করছে, চলতি মাসের মধ্যেই বই ছাপা এবং বিতরণ কাজ সম্ভব হবে।

অবশ্য একইদিন সচিবালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আগামী মার্চের আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছানো সম্ভব হবে না। দেশীয় ছাপাখানায় সব বই মুদ্রণ, পরিমার্জন এবং বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এ দেরি হচ্ছে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘আমাদের প্রিন্টার চায় ছাপতে। দেরি হলে অভিভাবকরা রাস্তায় নামবেন। তখন এনসিটিবি তাদের নিম্নমানের কাগজ দিয়েই ছাপার অনুমতি দেবে। তাদের লাভ হবে। এবারও তারা তাই চাইছে। আমরা তাদের ওপর নজরদারি রেখেছি যাতে তারা দ্রুত বই দেয়। কাগজের সংকট ও দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট এসব আমরা সমাধান করে দিয়েছি। এমনকি তাদের ব্যাংক লোন অনুমোদন করে দিয়েছি। আশা করছি দ্রুত বই ছাপার কাজ শেষ হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার কার্যাদেশ দিতে দেরি হলেও তাদের দরপত্রে অনেক কম রেট দেওয়া হয়েছে। তারা মাইনাস ৪০ শতাংশেও কাজ করেছে। এবার তারা ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পেয়েছে। কোনোটাই মাইনাসে যায়নি। তারপরও তারা কাগজের দামি বৃদ্ধির জন্য বই ছাপতে গড়িমসি করছে। এটা তাদের বিগত সরকার সুযোগ করে দিয়েছে। একসময় এনসিটিবি কাগজ মজুদ করে রাখত। তখন কাগজের সংকটের কথা বলতে পারত না। যখন তারা নিজেরা কাগজ কিনতে শুরু করল তখন তারা বেশি লাভের দিকে ঝুঁকে গেল। এখন বুঝতে পারছি তাদের কাগজ ছাড়া টেন্ডার করতে হবে। এখন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজ কিনবে না। এনসিটিবি কাগজের কিনে দেবে অথবা পেপার মিলের মাধ্যমে কাগজ সরবরাহ করা হবে। অথবা আর্ট কাগজ আমরা আমদানি করব অথবা আমদানির ব্যবস্থা করে দেব। এই যদি আমরা করি, তাহলে মনে হয় অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

সব বই ছাপার কাজ কবে নাগাদ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি মাঠে নেমেছি এবং তাদের সক্ষমতা আছে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ বই ছাপার। ১১ কোটি বই ছাপা হয়েছে। বাকি ৩০ কোটি বই ৩০ দিনের বেশি লাগার কথা নয়। জানুয়ারির মধ্যেই সব বই ছাপিয়ে ফেলা যায়।’

অবশ্য এ বছর বই ছাপানোর কাজ দেরি হওয়ার পেছনে এনসিটিবির পরিকল্পনার অভাবকে কারণ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এবার সরকারি পরিবর্তন হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এনসিটিবি একটা সুন্দর পরিকল্পনা নিতে পারত। যেসব বইয়ে পরিবর্তন নেই সেগুলো আমরা আগে ছাপাতে পারতাম। তা হলে শিক্ষার্থীরা কিছুটা দেরি হলেও বই পেত। কিন্তু এনসিটিবি সেটা না করে সব বই ছাপানোর কাজ একসঙ্গে ডিসেম্বরে শুরু করেছে। অথচ আগে বই ছাপানো শুরু হতো জুলাই-আগস্টে।’

সমিতির এ নেতা আরও বলেন, ‘এবার সরকার পরিবর্তনের পর পাঠ্যবইয়েও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এসবের জন্য একটা সময় লেগেছে। কিন্তু পরিকল্পনার অভাব ছিল। চারুকারু, ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, ভূগোল এসব বইয়ে কোনো পরিবর্তন নেই। তিন মাস আগে তাদের বলেছি, যেসব বইয়ে কখনই পরিবর্তন হয় না, সে বইগুলো আলাদা করে আগেভাগেই ছাপতে দেন। সেটা করেনি। এ বইগুলো যদি আগে ও পরিবর্তিত বইগুলো পরে দিত, তাহলে ছাপানোর কাজ এগিয়ে থাকত। আর পরিবর্তিত বইগুলোর যে অধ্যায় পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো বাদে অন্য অধ্যায়গুলো দিয়ে দিত, তাহলে ছাপানো হয়ে যেত। সেই পরিকল্পনা নেয়নি।’

দরকার ৪০ কোটি, ছাপা হয়েছে ১১ কোটি : এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই। মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে আট হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা ছাপা হচ্ছে।

কর্মকর্তারা আরও জানান, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ বেশ আগেই শুরু হয়েছে। এ বইয়ের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। এরপর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির কার্যাদেশ ও চুক্তিপত্র শেষে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এই বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের শেষদিকে চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের ছাপা শুরু হয়। আর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নবম ও দশম শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। তবে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এক বছর বই পড়ে এসএসসি পরীক্ষায় বসবে বলে তাদের বইয়ের কাজ আগে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ১১ কোটি বই ছাপা হয়েছে। বাকি আছে ৩৫ কোটি বই। সে হিসাবে এখনো ৭৩ শতাংশই ছাপা বাকি। তবে ছাপা হওয়া ১১ কোটি বইয়ের সম্পূর্ণটা শিক্ষার্থীদের হাতে যায়নি বলে জানিয়েছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা। তাদের মতে, ছাপানোর পর বাইন্ডিং ও কাটিং হতে সময় লাগে।

ছাপা শেষ হতে এপ্রিল : বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, বছরের প্রথম দিন যে ছয় কোটি বই দেওয়ার কথা দাবি করেছেন, তা সঠিক নয়। বই মূলত গেছে ২ কোটি ৮৫ লাখ কপি। প্রায় ৪১ কোটি বই ছাপতে হবে। এখন পর্যন্ত ১০ কোটির মতো বই ছাপা হয়েছে। যে কয়েকটা প্রেস ছাপার কাজ করছে, তারা যদি কাগজ ও কালিসহ আনুষঙ্গিক সব জিনিসপত্র ঠিকমতো পায়, তাহলেও দৈনিক বই ছাপতে পারবে ৫০ লাখ কপি। সে হিসাবে বাকি ৩৫ কোটি বইয়ের জন্য কমপক্ষে ৭০ দিন লাগবে। এখন বই ছাপা হচ্ছে ১৫-২৫ লাখ কপি। অর্থাৎ এপ্রিল লাগবে বই ছাপতে। বড় বইগুলো ছাপা বাকি আছে। ছাপা হয়েছে ছোট বইগুলো।

ছাপতে দেরির কারণ : মুদ্রণ শিল্প সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কী ধরনের কাগজ হবে, পুরু কতটুকু হবে, আকার কেমন হবে এসব সিদ্ধান্ত নিতে তিন মাসের বেশি সময় নেওযা হয়েছে। সিদ্ধান্ত না পেলে কাগজের মিলগুলো আগে থেকেই কাঁচামাল আমদানি করে রাখবে না। দেশে ৬০টির মতো কাগজের মিল আছে। দুটি বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে মৌসুমভিত্তিক কাগজ আমদানি করে। অন্যান্য বছর বই ছাপানোর কাজ শুরু হয় জুলাই-আগস্ট মাসে। এবার সব কাজ শুরু হয়েছে ডিসেম্বরে।

এ নেতা আরও বলেন, ‘আমরা প্রথম বই ছাপি। এরপর বাইন্ডিং ও কাটিং করি। তারপর এক ট্রাক বই নিয়ে উপজেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সব ধরনের বই নেই। তখন অন্য বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য ছাপানোর পর বই পাঠাতে দেরি হচ্ছে। এনসিটিবি দাবি করছে, ২০ জানুয়ারির মধ্যে সবাইকে বই দেবে। অথচ প্রেসকে বইয়ের কাভার দেবে জানুয়ারির শেষে। এটা স্ববিরোধিতা।’

পাঠদান ব্যাহত : বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বই দেরি করে দেওয়াতে স্কুলগুলোতে পড়ালেখা হচ্ছে না। ১ জানুয়ারি থেকে সব স্কুল খোলা। ক্লাস শুরু হয়েছে। সবাই বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলে যায়-আসে। শিক্ষকরা যে দুয়েকটা বই পেয়েছেন, সেটার ক্লাস নিচ্ছেন। কিছু ভালো স্কুল এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে অনলাইন ভার্সন ডাউনলোড করে ক্লাস নিচ্ছে। কিন্তু এভাবে তো চলে না।

শিক্ষকরা আরও বলেন, এখন মাধ্যমিকের দুটি পরীক্ষা ষাণ¥াসিক ও বাৎসরিক। ষাণ¥াসিক হয় জুনে। প্রাথমিকের তিনটি পরীক্ষা হয়। তাদের প্রথম পরীক্ষা এপ্রিলে। তার মানে এবার শিক্ষার্থীদের প্রথম পরীক্ষায় বসতে হবে বই ছাড়া।

শিক্ষকরা জানান, এ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে করোনা থেকে। করোনার সময় তিন বছর লেখাপড়া হয়নি। এরপর দুই বছর নতুন কারিকুলাম ছিল। সে সময় আক্ষরিক অর্থে পড়ালেখা ছিল না। প্র্যাকটিকাল হচ্ছিল। এবার আবার নতুন বই পাচ্ছে বছরের তিন-চার মাস পর। তাহলে লেখাপড়া হয় কীভাবে!

Sharing is caring!