প্রজন্ম ডেস্ক:
সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারত সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কেবলই কথার কথা। দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে একের পর এক প্রাণ যাচ্ছে বাংলাদেশির। কেবল বিগত বছরেই সীমান্তে গুলি আর নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২৫ জন। ভারতের পক্ষ থেকে বরাবরই সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। কার্যত সেসব প্রতিশ্রুতির কোনো প্রতিফলন নেই।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২৪ সালে সীমান্তে গুলি ও নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশি। প্রতি বছরই বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সীমান্ত হত্যাসহ চোরাচালান, মাদক ও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলেও সীমান্তহত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার কোনো প্রতিফলনই বাস্তবে পরিলক্ষিত হয় না। পতাকা বৈঠকেই সীমাবদ্ধ হয়ে আটকে থাকে সব প্রতিশ্রুতি।
সীমান্তে কিশোরী ফেলানী হত্যা ১৪ বছরের মাথায় এসে গতকাল মঙ্গলবার সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। দিবসটিতে ভারতের আগ্রাসনের জবাব দিতে কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডে জড়িত ভারতীয়দেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যখন ফেলানী হত্যার আন্তর্জাতিক বিচার এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ভূমিকার দাবি জানানো হচ্ছিল সে সময়টাতেই সীমান্তে আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সীমান্তে বিএসএফ জহুর আলী নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার পর লাশ নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চুনারুঘাট থানার ওসি মো. নুর আলম বলেছেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমরা বিজিবিকে সঙ্গে নিয়ে মরদেহ উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ঘটনাস্থলে পুলিশ সদস্যরাও রয়েছেন।
এর আগে মৌলভীবাজারের বড়লেখা সীমান্তে গত ২২ ডিসেম্বর গোপাল নামে এক চা শ্রমিকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। পরিবারের দাবি, পাহাড় থেকে বাঁশ আনতে গিয়ে অসাবধানে সীমান্তের জিরো লাইনের কাছে গেলে গোপালকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। এ সময় তার সঙ্গে থাকা অন্য শ্রমিকরা পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সীমান্তে গত ৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিএসএফের গুলিতে কামাল হোসেন নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন। হত্যার পর তার লাশ নিয়ে যায় বিএসএফ। ২৬ ঘণ্টা পর তার লাশ ফেরত দেওয়া হয়।
পরিবারের লোকজন বলেন, কামাল পিঁপড়ার বাসা ভেঙে পিঁপড়ার ডিম বিক্রি করতেন। এতে যা আয় হতো, তা দিয়ে সংসার চলত। তিনি কোনো ধরনের চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়। সীমান্তে হত্যা বন্ধে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দুটি দেশেরই আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। তবু সীমান্তে আইন লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করাটা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। এটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বড় সমস্যার সৃষ্টি করে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার রক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্তরা মনে করেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সীমান্তে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে তাদেরকে কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সীমান্ত হত্যা নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতের কড়া সমালোচনা করলেও হত্যা বন্ধ হয়নি। ৫ আগস্টের পরও বিএসএফের হাতে সীমান্তে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সংসদে প্রশ্নোত্তরে জানিয়েছিলেনÑ ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১০ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ সালে ২৪ জন, ২০১২ সালে ২৪ জন, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ এবং ২০১৮ সালে ৩ জন হত্যার শিকার হন।
এরপর সরকারি কোনো হিসাব পাওয়া না গেলেও মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে সীমান্তে নিহত হন ৩৭ জন ও আহত হন ৪৮ জন। ২০২০ সালে নিহত হন ৪২ জন ও ২৬ জন আহত হন। এরপর ২০২১ সালে নিহত ১৬ ও আহত ৯ জন, ২০২২ সালে গুলি ও নির্যাতনে নিহত ২৩ ও আহত ১৫ এবং ২০২৩ সালে ২৮ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হন।
কেবল সাধারণ মানুষ নন, বিএসএফের নির্যাতনের মুখ পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকেও। হত্যার শিকার হচ্ছেন এই বাহিনীর সদস্যও।
২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি যশোরের শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন বিজিবি সদস্য মোহাম্মদ রইশুদ্দীন। ওইদিন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়নের ধান্যখোলা বিওপির জেলেপাড়া পোস্ট-সংলগ্ন এলাকায় ভারত থেকে আসা একদল গরু চোরাকারবারিকে সীমান্ত অতিক্রম করে আসতে দেখে বিজিবি টহল দল। টহল দলের সদস্যরা তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা দৌড়ে ভারতের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বিজিবি টহল দলের সদস্য সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীন চোরাকারবারিদের ধাওয়া করতে করতে ঘন কুয়াশার কারণে দলবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে তাকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, তিনি বিএসএফের গুলিতে আহত হয়ে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
পরবর্তীতে ৯ মার্চ সকালে ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলনের শেষদিন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, গত ২২ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে যশোরের শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা সীমান্তে বিজিবি সদস্য রইশুদ্দিনের মৃত্যু কোনো টার্গেট কিলিং ছিল না। ওইদিন অন্ধকার ও কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। দুই পক্ষের মধ্যেই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।
বিএসএফ ডিজি নিতিন আগারওয়াল বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিক সীমান্তে মাঝেমধ্যে মারা যায়। যদিও আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে কেউ হত্যার শিকার না হয়। বাংলাদেশ বর্ডারে আমাদের অস্ত্র সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করেছি। আমরা সীমান্তে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্রের ব্যবহার চালু করেছি। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে-সীমান্ত হত্যা একদম কমিয়ে আনা।’
ওই সময় সীমান্তে হত্যা, আহত ও মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে যৌথ টহল জোরদারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ৩১ ডিসেম্বর সাতকানিয়ায় বিজিবির ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতীয় সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যাতে কোনো অবস্থাতেই পিঠ নয়, বুক দেখায়, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় সীমান্তে হত্যা বন্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৫ ডিসেম্বর সিলেটে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা সব সময় সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আমরা মনে করি, ভারতের অবিলম্বে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা উচিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসীন বলেন, ‘ভারত বার বারই আমাদের আশ্বাস দেয়, সীমান্তে কোনো নির্যাতন বা হত্যার ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সীমান্তে হত্যার ঘটনায় তদন্ত হয় কি না সেটাও দেখা উচিত।’
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকার এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার, আইনি সমঝোতা এবং দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তে নিরাপত্তার পাশাপাশি মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানো দুই দেশের সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
ফেলানী হত্যার ১৪ বছর
সীমান্তে কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডের পর পার হয়ে গেছে ১৪টি বছর। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর রামখানা অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নির্মম হত্যার শিকার হয় ফেলানী। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল তার মরদেহ। সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে থাকা ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেয়। ভারত এ ঘটনায় গণমাধ্যমসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বর্বরতা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফেলানী হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সীমান্তে ফেলানী হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। তাতে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের বিএসএফ বিনাবিচারে হত্যা করে, যা অমানবিক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র হাতে ভারতীয় বিএসএফ বার বার ঢুকে পড়ে, যা আমাদের সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, স্বাধীনতার লঙ্ঘন।
ভারতের সঙ্গে চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের পারস্পরিক সীমান্ত থাকলেও শুধু বাংলাদেশ সীমান্তে তারা অমানবিকভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়। এটা খুবই দুঃখজনক ও ন্যক্কারজনক এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। বক্তারা সীমান্ত হত্যা বন্ধে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে বলে মত দেন এবং সীমান্ত হত্যাকাণ্ডগুলোর আন্তর্জাতিক তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেন।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com