প্রজন্ম ডেস্ক:
হাসপাতালে ১৩৯ দিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত ২২ ডিসেম্বর রাতে মারা যায় ১২ বছর বয়সের শিশু আরাফাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আরাফাতের মৃত্যু হয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে। আরাফাতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দুদিন পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বিদেশে পাঠানোর কথা ছিল। তার আগেই ২২ ডিসেম্বর মারা যায় আরাফাত। তার মৃত্যুর কারণে অন্য আহতদের চিকিৎসা নিয়ে শুরু হয় তীব্র অসন্তোষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রথম দিকে শিশু আরাফাতের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছিল। তবে এক মাস ধরে অবস্থা অবনতি হতে থাকে। এর আগে তার তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল। পরে উন্নত চিকিৎসা দিতে তাকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় গঠিত টিমের সদস্য ডা. হুমায়ুন কবির হিমু জানান, পাঁজরে গুলি লাগার কারণে আরাফাতের ফুসফুস ও মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
গুলিতে তার ফুসফুস ছিদ্র হয়ে যায়। একইসঙ্গে মেরুদণ্ড ভেঙে গুঁড়া হওয়ার পাশাপাশি পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে থেকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠানো হলে পরবর্তী সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে আরাফাত সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিল।
শিশু আরাফাতের মৃত্যুর পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সচিব তারেক রেজা জানান, তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছিল প্রাথমিকভাবে। কিন্তু গত একমাস যাবৎ অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এর আগেও তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এক পর্যায়ে তাকে দেশের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক এক সপ্তাহ টানা দৌড়ঝাঁপের পর ২৪ ডিসেম্বর আরাফাতের জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন ১০ জন
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন অনেকে। এর মধ্যে রাজধানীর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭৮ জন। আন্দোলনে গুলিতে চোখ নষ্ট হয়েছে চার শতাধিক ব্যক্তির। এর মধ্যে দুই চোখ হারিয়েছেন অনেকে। আর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) চিকিৎসাধীন আছেন ৯৮ জন। তাদের মধ্যে ২১ জনের হাত ও পা কাটা গেছে। কারও গুলিবিদ্ধ স্থানে মাংস প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে। এদের অনেকেরই দরকার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার। এখন পর্যন্ত ১০ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে।
যে কারণে আহতদের ক্ষোভ
বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে অসন্তোষ কাটছে না সহজে। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে গঠিত কমিটিতে থাকা সদস্যরা। তাদের ক্ষোভের কারণ – দেরি করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোয় আহতদের জটিলতা বাড়ছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ডা. তাসনিম জারা রবিবার (৫ জানুয়ারি) অপর সদস্য রাফিদ এম ভুঁইয়ার পোস্ট শেয়ার করে জানতে চেয়েছেন বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর। তিনি বলেছেন, ‘বিদেশে রোগী পাঠানোর বিষয়টি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে। তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত।’
রাফিদ তার পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘তুরস্কের একটি সংস্থা নিজেদের অর্থায়নে ৫০০ জন আহত রোগীর চোখের অপারেশন করতে চেয়েছে, বাংলাদেশ সরকারকে বলা হয়েছিল—তুরস্কে যাওয়ার প্লেন ভাড়াটা দিলেই হবে। রোগীদের চিকিৎসা খরচ ও তাদের দেশে ফেরত আসার টাকাও ওই সংস্থা বহন করবে। সেটার আপডেট কী? এখনও কোনও আহত কেন তুরস্কে যায়নি? জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের শত কোটি টাকা কেন আহতদের পেছনে উজাড় করা হচ্ছে না?’
সেই পোস্ট শেয়ার করে তাসনিম জারা উল্লেখ করেন, ‘আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে সরকার এবং ফাউন্ডেশনের পৃথক দায়িত্ব রয়েছে। ফাউন্ডেশন এবং সরকার উভয়কেই ব্যাখ্যা করতে হবে যে আহতরা যখন অপরিসীম দুর্ভোগ সহ্য করছে, তখন কেন এত সময় লাগছে। সরকার প্রতিটি শহীদ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে প্রতিশ্রুতি দিলেও একটি টাকাও ছাড় করা হয়নি। অপরদিকে ফাউন্ডেশন যে ১০০ কোটি টাকা পেয়েছে—তার মাত্র অর্ধেক বিতরণ করেছে।’
জুলাই আন্দোলনে আহতদের নিয়ে কাজ করা ‘লড়াকু’র সংগঠক কানিজ ফাতেমা মিথিলা রবিবার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আজ আহত কয়েকজন শিক্ষার্থী, ভলান্টিয়ার টিম, ডাক্তার প্রতিনিধিসহ বেশ কয়েকজনের একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো আহত কয়েকজনের ভিসাসহ সংশ্লিষ্ট পেপার ওয়ার্কে সরাসরি সাহায্য করা এক আপা (বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত) সরকারি অব্যবস্থাপনার কথা বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার কাছ থেকেই জানলাম, কিছু দিন আগে মারা যাওয়া ১২ বছরের শিশু আরাফাত পাসপোর্ট হতে দেরি হওয়ায় মারা গেছে! সাড়ে ৪ মাস লাগে একটা পাসপোর্ট হতে? অথচ আমাদের শোনানো হয়েছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রেডি ছিল।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘মিটিংয়ে উপস্থিত চোখে গুলিবিদ্ধ এক শিক্ষার্থী ছিল, যাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত খরচে ও উদ্যোগে সম্প্রতি ব্যাংককের রুটনিন আই হসপিটাল এবং বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চেকাপ করিয়ে এনেছেন প্রবাসী এক আপা। সেই শিক্ষার্থী ছেলেটা বলছিল, ব্যাংককের ডাক্তাররা বলেছে—আর কিছু দিন আগে গেলে তার ডান চোখটা বাঁচানো যেতো। দেরি হয়ে যাওয়ায় এখন আর কোনও সুযোগ নেই।’
তিনি লিখেছেন, ‘চোখ ও মাথা থেকে শুরু করে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে গুলিবিদ্ধ মানুষগুলোর জন্য প্রতিটি মুহূর্ত জীবন-মরণের সমান। সেই অঙ্গগুলো বোঝে না যে সরকার নতুন নাকি পুরাতন, অভিজ্ঞ নাকি অনভিজ্ঞ। আমলারা সহযোগিতা করছে নাকি করছে না, ব্লা ব্লা। গত ৫ মাস ধরে যখন দেখছি যে এক এক করে মানুষগুলো অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে, চিরতরে অঙ্গহানির শিকার হচ্ছে, এমনকি মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে এবং হাজারো চিৎকার-আর্তনাদ শুধু ওপর মহল কেন, সমাজের বিবেকদের এবং সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার মতো যথেষ্ট নাড়া দিতে পারছে না—তখন অসহায়ত্ব, ক্ষোভ, নিজেদের সীমিত সামর্থ্য আর হতাশায় মরে যেতে ইচ্ছে করে।’
গত ২৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমানের সভাপতিত্বে আন্দোলনে গুরুতর আহতদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে একটি সভা হয়। সভায় জানানো হয়, গুরুতর আহত ২১ জনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, যাদের বিদেশে চিকিৎসা প্রয়োজন। এর মধ্যে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৯ জন, নিটোরে চিকিৎসাধীন ৭ জন (একজন ঢাকা মেডিক্যাল থেকে রেফার করা) এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫ জন আছেন। তাদের বিদেশে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় সভায়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তালিকায় থাকা ৩ জনের পাসপোর্ট আছে, আর ২ জনের পাসপোর্ট প্রক্রিয়াধীন আছে। বাকিদের তথ্য পাওয়া যায়নি। গুরুতর আহতদের পাসপোর্ট তৈরির বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় পরিচালনার জন্য জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন এবং সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সমন্বয় করার বিষয়ে মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এর আগে যাদের বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের খরচ সরাসরি হাসপাতালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছে। যেহেতু নির্দিষ্ট কোনও ব্যয় এখানে নেই— তাই তদারকি করার জন্য বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারাই তদারকি করবেন এবং খরচ তারাই পরিচালনা করবেন। হাসপাতালের বিল পরিশোধ সহজ করার জন্য হাইকমিশন কিংবা দূতাবাসের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিদেশে পাঠাতে বিলম্ব কেন হচ্ছে, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, এখানে অনেক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা লাগছে, যথাযথ কমিটির অনুমোদন লাগছে। অর্থের প্রাপ্যতারও একটা বিষয় আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত ব্যবস্থা করতে।
নিটোর পরিচালক ডা. আবুল কেনান বলেন, ‘আহতদের বেশির ভাগেরই অবস্থা এখন স্থিতিশীল। এর মধ্যে আমরা ৬ জনকে বিদেশে পাঠানোর জন্য চিঠি দিয়েছি। তাদের বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। উপদেষ্টা বলেছেন, দ্রুত সব কিছু ব্যবস্থা করা হবে। আশা করা যায় শিগগিরই তারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাবেন।’
Sharing is caring!