প্রজন্ম ডেস্ক:
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পগুলোর তালিকায় থাকা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো কার্যত গুরুত্ব হারিয়েছে। বন্ধ না হলেও প্রকল্পগুলোর তদারকি ও অগ্রগতিতে আর আগের মতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এগুলোর বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর গত ভৌত অগ্রগতি ৯০ শতাংশের বেশি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় মনিটরিং কমিটির বৈঠক না হওয়া এবং সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় প্রকল্পগুলোর বাকি কাজটুকু নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শেষ হওয়া নিয়ে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসা প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ কীÑ এমন আলোচনাও সামনে এসেছে।
মোট আটটি প্রকল্প ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ায় সেটি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু ছাড়া বাকি সাত প্রকল্পের শুরু থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত গড় ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। প্রকল্পগুলোর আওতায় খরচ হয়েছে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৩২ লাখ ৮০ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৯৯.৫০ শতাংশ, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথের ৯৮.৮০ শতাংশ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের ৯৩.২২ শতাংশ, মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্প ৯০ শতাংশ, মহেশখালী-মাতারবাড়ীর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ৯০.৪০ শতাংশ ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৭.৮১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে প্রকল্পগুলোতে আবার গতি ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এসব প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন দেশের আর্থিক অগ্রগতি এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করবেÑ এমন অভিমত সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের।
ফাস্ট ট্র্যাকের বর্তমান অবস্থা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিশ্চিত করা হতো। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত পাঁচ মাসে এই কমিটি আর পুনর্গঠন হয়নি। এ অবস্থায় তদারকির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কাজের গতিও অনেকটা স্থবির হয়ে আছে।
ফাস্ট ট্র্যাকের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর বিষয়ে একটি কংক্রিট সিদ্ধান্ত দরকার। কেননা এগুলো চলবে, না কি যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায়ই বন্ধ করা হবেÑ এর কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আগের মতো প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির কোনো বৈঠকও হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আগে তিন মাস পরপর নিয়মিত বৈঠক হতো। এখন বৈঠক হচ্ছে না। এসব নিয়ে কোনো নির্দেশনাও নেই। পাশাপাশি কোনো পর্যালোচনা হচ্ছে বলেও মনে হয় না।’
আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জানান, তবে আইএমইডি থেকে আগের মতোই মনিটরিং প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো ফিডব্যাক পাওয়া যায় না। এসব প্রকল্পে যেহেতু সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা আছে, সেহেতু অবহেলার সুযোগ নেই।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একটি সূত্র জানিয়েছে, রামু-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের অংশটি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৬ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। তবে তদারকির অভাবে এগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
মেগা প্রকল্পে মেগা লুটপাট
জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেশের সাতটি মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রকল্পগুলোতে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, যা শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ৯৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত।
প্রতিবেদন অনুসারে, শহর এলাকায় চার লেনের রাস্তা নির্মাণে গড় ব্যয় হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই ব্যয় ভারতের ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, চীনের ৩৯ কোটি টাকা এবং পাকিস্তানের ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার তুলনায় অনেক বেশি।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ১১৩ কোটি ৭ লাখ টাকা, যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি।
প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সময় দুর্বল সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশায় ঘনঘন পরিবর্তন এবং পরিকল্পনার স্বচ্ছতার অভাবকে এই বাড়তি ব্যয়ের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আইএমইডি এবং অন্যান্য সংস্থার নিয়মিত প্রতিবেদনেও এই অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়গুলো উঠে এসেছে। তবে বারবারই তা উপেক্ষা করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পগুলোর আড়ালে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিদেশি পরামর্শকদের হুমকি দিয়ে নিজেদের স্বার্থে কাজ করিয়েছেন। এ ধরনের দুর্নীতির ফলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়েছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ঋণের বোঝা চেপে বসেছে।
মেগা প্রকল্পের এই লুটপাট উন্নয়নের নামে ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট প্রমাণ বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় ও অগ্রগতি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি অক্টোবর পর্যন্ত ৬৭.৮১ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬৭.৮১ শতাংশ। প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের বড় অংশ অর্থায়ন করেছে রাশিয়া, যার ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
মেট্রোরেল লাইন-৬ : উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর চালু হয়। নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ছিল ৭৩.৮৪ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ছিল ৯০ শতাংশ। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা, যেখানে প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ : এই প্রকল্পে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৮.৬১ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৯৬.৮৫ শতাংশ। নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা, যেখানে বরাদ্দ ছিল ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প : প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৯৯.৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৯৬.৯২ শতাংশ। এ পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত কার্যক্রম : এই প্রকল্পে ১২টি উপপ্রকল্প অন্তর্ভুক্ত। নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯০.৪০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮১.৫৬ শতাংশ। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৪৬ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর : পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৯৩.২২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮৬.৯৬ শতাংশ। প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩ হাজার ৮০৩ কোটি ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে।
দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ : প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৯৮.৮০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৫১.৪৪ শতাংশ। জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যেখানে বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। রামু-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের অংশটি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে।
Sharing is caring!