প্রজন্ম ডেস্ক:
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) হলো একজন ব্যক্তির নাগরিকত্বের প্রমাণ। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে এনআইডি তৈরির কার্যক্রম শুরু করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অথচ দীর্ঘ ১৭ বছরেও এনআইডির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি এ দেশের অনেক নাগরিক। আর সে কারণেই এনআইডি সংশোধনকারীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের ভুলের কারণ গ্রাহক নিজেই। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে বেপরোয়া কেউ কেউ। আইন লঙ্ঘন করে যেকোনো উপায়ে এনআইডি পাওয়াই তাদের লক্ষ্য। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনিষ্পন্ন এনআইডি সংশোধন আবেদনের সংখ্যা ৩ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি।
আবেদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে এবং ইসির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এনআইডি সংশোধনের জন্য করা ২০ থেকে ৩০ শতাংশের আবেদনই নিয়মবহির্ভূত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাদের অনেকে কাজ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে বারবার অনুরোধ করেন, কান্নাকাটি করেন। কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক আর্থিক চুক্তি করেও এনআইডি বাগিয়ে নেন। এ ধরনের গ্রাহকের মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনী, প্রবাসী/বিদেশগামী, চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যাই বেশি। সরকারি-বেসরকারি অনেক চাকরিতেই বয়সসীমা গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সার্কুলার অনুযায়ী বয়স মেলাতে অনেকের আবেদনের বিষয় বয়স কমানো বা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য বাদ দিয়ে মিথ্যা তথ্যে এনআইডি করিয়ে নেওয়াই তাদের লক্ষ্য। একই বিষয়ে একাধিকবারও আবেদন করেন কেউ কেউ। যৌক্তিক কারণে বাতিল হওয়ার পরও এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যারা পাঁচ থেকে সাতবারও সংশোধনের আবেদন করেছেন। এ ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি কতবার এনআইডি সংশোধনের আবেদন করতে পারবেন, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি ইসি।
এনআইডি সংশোধনের সংবাদ সংগ্রহে সম্প্রতি আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে গিয়ে দেখা যায়, সপ্তম তলায় এনআইডি বিভাগের এক কর্মকর্তার রুম থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হচ্ছেন এক নারী। জিজ্ঞেস করলে জানান, তার নাম কুলসুম বেগম (ছদ্মনাম)। বাড়ি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলায়। বিগত ৬ বছর তিনি কাতার ও সৌদি আরবে গৃহশ্রমিকের কাজ করেছেন। ঘরে তার অসুস্থ স্বামী ও তিন মেয়ে। সংসারের অভাব দূর করতে আবারও বিদেশে কাজে যেতে চান। কিন্তু বয়স বেশি (৪১ বছর) হওয়ায় এজেন্টরা তাকে নিতে চাচ্ছে না।
কুলসুম বলেন, ‘এজেন্টরা কইছে আমি নাকি বুড়া হইয়া গেছি। এনআইডিতে বয়স ৩৫ বছর দেখাতে পারলে তারা পাঠাইতে পারব। আফা, এই দ্যাশে আমি কোনো বাড়িতে কাজ করলে আমারে ১০-১২ হাজার টাকার বেশি বেতন দিত না। আর ওই দ্যাশে যাইতে পারলে মাসে বেতন পামু ৪০-৪৫ হাজার টাকা। এ কারণেই বিদ্যাশে যাইতে চাই। কিন্তু অফিসার বলতেছে এইডা নাকি করা সম্ভব না। এখন আমি কী করুম আফা? কীভাবে সংসার চালামু, কিছুই বুঝতে পারতেছি না।’
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইসি কর্মকর্তা বলেন, ‘নিয়মের বাইরে গিয়ে আমাদের কিছু করার উপায় নেই। ওই নারী দ্বিতীয় দফায় আট বছর বয়স কমানোর আবেদন করেছেন। আইনে একই বিষয়ে দুবার সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া তার কাগজপত্র পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এবার তার চাওয়া অনুযায়ী সংশোধন করা হলে মেয়ের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য হবে মাত্র ৯ বছর; যেটা অনৈতিক। এসব কথা বুঝিয়ে বলার পরও তিনি বুঝতে চাচ্ছেন না, কান্নাকাটি করে বারবার অনুরোধ করছেন। এ রকম কিছু ব্যক্তি আসেন, যারা কিছুতেই বুঝতে চান না, আমাদের সময় নষ্ট করেন। এ ধরনের আবেদনকারীদের চাপে আমরা বিব্রত, ক্লান্ত। তাদের চাপে আমাদের নিয়মিত কাজে বিঘ্ন ঘটে, ফাইল ক্লোজ করতেও দেরি হয়।’
তিনি আরও জানান, শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থী ও বিদেশগামীদের জন্য কিছু বিষয়ে এবং মানবিক কারণে দুই-এক বছর বয়স কমানো-বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করা হয়। যেমন- ২০০৮ সালে ক্লাস এইটে পড়ার সময় বয়স বাড়িয়ে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ভোটার হয়েছিলেন নরসিংদীর রুহুল আমিন (ছদ্মনাম)। এবার সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স ১০ বছর (১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫) কমাতে আবেদন করেছেন। তবে রুহুলের ঘটনা তদন্ত শেষে সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার সংশোধন আবেদন গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট ইসি কমিটি। এমনও দেখা গেছে, একই মা-বাবার সন্তানরা সার্টিফিকেটে তাদের মা-বাবার নাম ভিন্ন বানানে লিপিবদ্ধ করেছেন। পরে তাদের সবাই একসঙ্গে সংশোধনের আবেদন করলে তদন্ত সাপেক্ষে সেগুলো সমাধান করা হয়।
এ বিষয়ে ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র শাখার মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এনআইডিতে সাধারণত দুভাবে ভুল হয়ে থাকে। একটি হলো অজ্ঞতাবশত তথ্য প্রদান বা ভুল তথ্য প্রদান। অন্যটি অসতর্কতাবশত সার্ভারে তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার সময় করণিক ভুল। এ ছাড়া বিশেষ উদ্দেশ্যে ও স্বার্থ হাসিলের জন্য অনৈতিক উপায়ে এনআইডি হাসিল করেন, যেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সংশোধন আবেদনকারীদের প্রায় ৬০ শতাংশই আগে নিজেই ভুল তথ্যে এনআইডি নিয়েছিলেন, পরে ব্যক্তিগত বা পরিবারের প্রয়োজনে অথবা বিশেষ উদ্দেশ্যে তা সংশোধনের আবেদন করেন।
নাগরিকদের এনআইডি সেবাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। একদিকে সংশোধন আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়, অন্যদিকে নাগরিকদের নতুন আবেদন জমতে থাকে। গ্রাহকদের আবেদনে থাকা ভুলের ধরনগুলো পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো ক্যাটাগরি ভিত্তিতে সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে থাকি। কেউ অজ্ঞতা, অসচেতনতা, অসাবধানতাবশত ভুল তথ্য দিয়ে থাকলে সেগুলো দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে। এ ছাড়া কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে মাঠপ্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত অনলাইন মিটিং করছি। সম্প্রতি সংশোধন বিভাগে জনবলও বাড়ানো হয়েছে। অনলাইনে দাখিল করা সব আবেদনের ক্যাটাগরি পাঁচ কার্যদিবসে নির্ধারণ এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সেগুলো নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনি কাঠামোর বাইরে গিয়ে কোনো কাজ না করতে সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
সরকারি ও বেসরকারি রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণসহ বেশির ভাগ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এনআইডি এখন অনিবার্য। এ ছাড়া চাকরির আবেদন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ যে কোনো ক্ষেত্রেই জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক। এ কারণে আগে এনআইডিকে এবং এতে থাকা সঠিক তথ্যেকে যারা বেশি গুরুত্ব দেননি, তারাও সঠিক তথ্য দিয়ে এনআইডি সংশোধন করাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে বেড়েছে এনআইডির সংশোধনের আবেদন। জাতীয় পরিচয়পত্রে তথ্য ভুলের কারণে অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেন সেবাগ্রহীতারা। তবে কমিশন বলছে, এনআইডি নিবন্ধনের সময় নাগরিকদের অসচেতনতা এবং নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভুল/মিথ্যা তথ্যে করা আবেদনগুলোর তদন্ত ও নিষ্পত্তি করতে সময় বেশি লাগে।
ইসির দপ্তরে জমে থাকা আবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাপরিচালক জানান, তিন মাস আগেও ইসিতে ছয় লাখের বেশি আবেদন জমা ছিল। তবে ক্র্যাশ প্রোগ্রামে প্রায় দুই লাখ আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। তার পরও ইসিতে জমে আছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৩৬টি আবেদন। সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে ১ জানুয়ারি থেকে পুনরায় তিন মাসের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে। সংশোধনের আবেদনগুলো নিষ্পত্তির পাশাপাশি নতুন করে যাতে গ্রাহকের ভুলের পরিমাণ না বাড়ে, সে ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে নানামুখী প্রচার চালানোর কথা ভাবছে সংস্থাটি।
Sharing is caring!