প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতাল। নার্সস্টেশনে এক মা এসে নার্সকে জানান, তার সন্তান স্যালাইন খেতে চাচ্ছে না। ফিডারে করে খাওয়াবেন কি না? তখন নার্স তাকে বলেন, ‘না ফিডারে খাওয়ানো যাবে না। যেভাবে বলেছি সেভাবে চামচ দিয়ে খাওয়াতে হবে।’
সেই মা বললেন, ‘খেতেই তো চায় না। কীভাবে খাওয়াব। ফিডারে দিলে হয়তো খেতে পারে।’
এর কিছুক্ষণ আগেই এই মাকে নার্স বুঝিয়ে বলেছিলেন, প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর চামচে করে, পাঁচ চামচ স্যালাইন খাওয়াতে। তার পরও তিনি আবার এসেছেন ফিডারে খাওয়ানো অনুমতি নিতে। তখন নার্স তার কাছে জানতে চান তিনি চামচে করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন কি না? জবাবে চেষ্টা করেননি বলে জানিয়ে ওই মা বলেন, চেষ্টা করলেও খাবে বলে মনে হয় না। তখন নার্স তাকে বলেন, আপনি অন্তত আগে চেষ্টা করেন।
ওই মা গতকাল বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) তার ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে এই হাসপাতালে আসেন। বাসায় তিনি ফিডারে করে শিশুকে স্যালাইন খাইয়েছেন। শুধু এই মা-ই নন, ডায়রিয়া হলে অনেকেই সন্তানকে সঠিক নিয়মে স্যাল্যাইন খাওয়ান না। পানিতে সঠিক নিয়মে স্যালাইন মেশান না। কেউ ফিডারে, কেউ মগে, কেউ গ্লাসে, কেউ কাপে, কেউ বাটিতে নিজের ইচ্ছামতো অনুমান করে পানি দিয়ে স্যালাইন মিশিয়ে খাওয়ান। এতে কখনো কখনো স্যালাইনের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, যা শিশুর জন্য হতে পারে মারাত্মক ক্ষতির কারণ। তাই সঠিক নিয়মে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিডিআর,বি চিকিৎসকরা জানান, ডায়রিয়ায় মৃত্যুর বড় কারণ হচ্ছে পানিশূন্যতা। এই সময়ের ডায়রিয়ায় খুব একটা পানিশূন্যতা দেখা দেয় না। সে জন্য বেশি করে স্যালাইন খাওয়ানো যাবে না। স্যালাইন বানানো এব্ং খাওয়ানোর নির্দেশনা সঠিকভাবে মানতে হবে। বয়স-ওজন হিসেবে যতটুকু খাওয়ানোর কথা ঠিক ততটুকুই খাওয়াতে হবে। পানিশূন্যতা মনে করে মাত্রাতিরিক্ত স্যালাইন খাওয়ালে রক্তের সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। সোডিয়াম বেড়ে গেলে খিচুনি, ব্রেন স্ট্রোক বা কিডনি ফেইলের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। মৃত্যুও হতে পারে।
২০২৪ সালের অক্টোরর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আইসিডিআরবিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ৬২৬ জন শিশুর রক্তের সোডিয়াম পরীক্ষা করা হয়। এতে ৯১ শিশুর রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বেশি পাওয়া যায়। সে জন্য অবশ্যই মনে রাখতে হবে স্যালাইনও ওষুধ। এটার মাত্রাতিরিক্ত বা ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যাবে না।
আইসিডিডিআর,বি ঢাকা হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, ‘ভাইরাল টাইপের ডায়রিয়া পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। অনেক বেশি বাথরুম করলেও স্যালাইন বেশি খাওয়ানো যাবে না। বয়স অনুযায়ী যত কেজি ওজন তত চামচ স্যালাইন খাওয়াতে হবে। যদি শিশুর ওজন ১০ কেজি হয়, তাহলে প্রতিবার পাতলা পায়খানা করার পর চা-চামচের ১০ চামচ স্যালাইন খাওয়াতে হবে। অনেকেই ফিডারে দুধের মতো করে স্যালাইন খাওয়ান। এটা করা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘ভাইরাল ডায়রিয়ার জন্য এমন কোনো ওষুধ নেই, যেটা খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স করবে। এটার জন্য সময় লাগবে। ভাইরালটা একটা সেলফ লিমিটিং ডিজিজ। এটা শরীরের মধ্যে নিজে নিজে নষ্ট হয়ে যাবে। সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষো করতে হবে। যে শিশুর ইমিউনিটি যত ভালো, সে তত দ্রুত সুস্থ হবে।’
খাবার ঠিকমতো খাওয়াতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মায়েরা অনেক সময় বলে থাকেন দুধ খাওয়ালেই দুধের মতো টয়লেট করে। তারা মূলত একটার সঙ্গে একটা মেলান। তারা মনে করেন, দুধ খাওয়ানো বন্ধ করলে হয়তো পায়খানা হবে না। এটা আসলে সে রকম বিষয় না।’
প্রতিবছরই শীতের এই সময়ে শিশুদের ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মৌসুমের চেয়ে এবার রোগী বেশি। ২০২৩ সালের শেষ দুই মাসের তুলনায় ২০২৪ সালের শেষ দুই মাসে রোগী বেশি হয়েছে। ২৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসে দিনে গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। ২৪ সালের নভেম্বর- ডিসেম্বরে গড়ে ৮৫০ থেকে ৯০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।
আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র কমিউনিকেশন ম্যানেজার এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান বলেন, এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ভর্তি রোগীদের মধ্যে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশু।
তিনি বলেন, নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই চার মাস রোটা ভাইরাসের প্রভাব বেশি থাকে। আইসিডিডিআর,বিতে ভর্তিপ্রতি ৫০তম রোগীর টয়লেট পরীক্ষা করে দেখা হয়- ডায়রিয়ার কারণ ভাইরাস নাকি ব্যাকটেরিয়াজনিত। পরীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীর ডায়রিয়া হচ্ছে রোটা ভাইরাসের কারণে। বাকি ৫০ শতাংশ অন্য ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার কারণে হচ্ছে।
আইসিডিডিআর,বির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ৮৯১ জন, ২৯ ডিসেম্বর ৮২৬ জন, ৩০ ডিসেম্বর ৯১৩ জন, ৩১ ডিসেম্বর ৮৮৪ জন। ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি ৮৫০ জন। গতকাল বৃহস্পতিবার দায়িত্বে থাকা নার্স মো. রাকিবুল ইসলাম বলেন, এখন রোগীদের মধ্যে শিশু বেশি। বুধবার ভর্তি ৮৫০ জনের মধ্যে ৭৫০ জনের মতোই ছিল শিশু।
আইসিডিডিআর,বি ঢাকা হাসপাতালে ঢুকেই প্রথমে নিবন্ধন ডেস্ক। সেখানে পাশেই ওজন মাপা হয়। তারপর নার্স ডেস্ক, এরপর চিকিৎসক ডেস্ক। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেখা যায় এই তিন ডেস্কের সামনে ২৩টি শিশুকে কোলে নিয়ে অপেক্ষায় আছেন অভিভাবকরা। এসব শিশুর বেশির ভাগের বয়স দুই বছরের নিচে। দু-একজনের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। এক রোগীর মাকে চিকিৎসক জানাচ্ছিলেন তার শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। কমতে সাত দিন লাগবে। শিশুর মা জানাছিলেন পাঁচ দিন হলো অসুস্থ। তখন চিকিৎসক জানান, আর দুই দিন পর কমতে শুরু করবে।
গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে নিবন্ধন করেন ৫৭ জন, সকাল ১০টা পর্যন্ত ১৩০ জন, বেলা ১১টা পর্যন্ত ১৮১ জন, দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪৮ জন, বেলা ১টা পর্যন্ত ৩১২ জন। ডেটা ম্যানেজমেন্ট সেলের দায়িত্বে থাকা শুভ বলেন, এই ৩১২ জনের মধ্যে ৯৮ শতাংশই শিশু।
বেলা ১টার দিকে দুটি ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে ৮৮ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। যাদের অধিকাংশের বয়স দুই বছরের নিচে। কামরাঙ্গীরচর থেকে ১৬ মাস বয়সী আবদুল্লাহকে নিয়ে বসে ছিলেন তার মা ফাহিমা।
তিনি বলেন, ‘৩১ ডিসেম্বর থেকে বমি, পাতলা পায়খানা, জ্বর। কমছে না। তাই এখানে নিয়ে এসেছি। ভর্তি করে দিয়েছে।’
মুন্সীগঞ্জ থেকে আগের রাতে মেয়ে মিনতাকে (১) নিয়ে এসেছেন তার মা-বাবা। মিনতার বাবা মতিউর রহমান জানান, চার-পাঁচ দিন ধরে পাতলা পায়খানা ও বমি। সারা দিনই পাতলা পায়খানা হতে থাকে। এলাকায় ডাক্তার দেখিয়েছেন। কমে না। তাই নিয়ে এসেছেনে আইসিডিডিআর,বিতে। এখানে ভর্তির পর একটু অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
মাদারীপুরের শিবচর থেকে বুধবার দুপুরে ১৩ মাস বয়সী রাফিয়াকে নিয়ে এসেছেন তার মা-বাবা। তার মা বিথি বলেন, ‘মেয়ের সাত দিন ধরে টয়লেট করছে। জ্বর ছিল। জ্বর এখন কমেছে। সকাল থেকে আমারও শুরু হয়েছে।’
কখন হাসপাতালে আনতে হবে?
এ বিষয়ে আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, অতিরিক্ত বমি করলে, কিছু খাওয়াতে না পারলে, আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিলে, অনেক জ্বর থাকলে, পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, বমিরও একটা বিষয় আছে, ঘণ্টায় যদি তিনবারের বেশি বমি করে, তার মানে সে কিছুই পেটে রাখতে পারছে না। স্যালাইন দিচ্ছেন আর সে বের করে দিচ্ছে, তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে। ভাইরাল ডায়রিয়ায় জ্বর থাকে। কিন্তু যদি অতিরিক্ত জ্বর থাকে, তাহলেও হাসপাতালে আনতে হবে। শিশুর মানসিক আচরণে পরিবর্তন এলে। শিশু যে রকম হাসিখুশি থাকে, খেলাধুলা করে, যাদের ডায়রিয়া হয় তাদেরও কিন্তু অ্যাক্টিভিটি স্বাভাবিকই থাকে। যদি দেখা যায় বাচ্চা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে, ঘাড় সোজা করে রাখতে পারছে না, শিশুর মুখে খাবার দেওয়া যাচ্ছে না অথবা ভীষণ খিটখিটে হয়ে গেছে, অর্থাৎ কোনোভাবেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। এই পরিবর্তনগুলো অ্যালার্মিং সাইন। তাহলে শিশুকে হাসপাতালে আনতে হবে।
প্রতিরোধ কীভাবে?
ডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, দুভাবে প্রতিরোধ করা যায়। একটা হচ্ছে ভ্যাকসিন দিয়ে। তাহলে আশঙ্কা কমে যায়। এটা তিন মাস বয়স থেকেই দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, বিশুদ্ধ পানি ও গরম খাবার খাওয়ানো। হ্যান্ড হাইজিনটা ভালোভাবে মেইনটেইন করতে হবে। মলমূত্র ত্যাগ করার পর শিশুকে পরিষ্কার করে সাবান দিয়ে হাত অবশ্যই ধুতে হবে। শিশুকে প্রতিবার খাবার খাওয়ানোর আগে হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে।
Sharing is caring!