প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৭ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

প্রশাসন বনাম ২৫ ক্যাডার

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ৪, ২০২৫, ০৯:১২ পূর্বাহ্ণ
প্রশাসন বনাম ২৫ ক্যাডার

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

প্রশাসনে মুখোমুখি অবস্থানে দুই পক্ষ। এক পক্ষে প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বিপরীতে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

 

প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা চাইছেন, উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব পদে কেবল এই ক্যাডার সার্ভিস থেকেই পদায়ন হবে। অন্য ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের দাবি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন সেই পেশার যোগ্য ও উত্তীর্ণ কর্মকর্তারা।

 

ইতোমধ্যে নিজেদের সার্ভিসের দাবির পক্ষে কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছেন প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ সার্ভিস ক্যাডার কর্মকর্তারা। উভয় পক্ষের দাবি, তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে নয়। তবে ইতোমধ্যেই দুই পক্ষের দাবি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

 

গত ২৫ ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের পক্ষে এক যৌথ সভার আয়োজন করে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা)।

 

এই সভায় প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের পক্ষে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। একই সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কমিশনকে ঘরে ফিরে যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ সভায় হুমকি দিয়ে বলা হয়, অন্যথায় কঠিন কর্মসূচি দেওয়া হবে।

 

এদিকে শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি)-এ অনুষ্ঠিত অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মোর্চা ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর এক আলোচনা সভা হয়েছে। সেখানে দাবি জানানো হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ২৫ ক্যাডারের মতামতের প্রতিফলন থাকতে হবে। গত ৫৩ বছর এসব ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের প্রতি যে বৈষম্য ও অন্যায় করা হয়েছে তার সুষ্ঠু সমাধান দাবি করা হয় আলোচনা সভায়। সেখানে ঘোষণা দেওয়া হয়, অন্যথায় জনসমর্থন আদায়ে আগামী এক মাস সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ অন্য কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

 

দুই ক্যাডার সর্ভিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয় পদোন্নতির কোটা নিয়ে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের সুপারিশে থাকবে- উপসচিব পদে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কোটা রাখা হবে। এ ছাড়া ক্যাডার সার্ভিস থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার সার্ভিসকে ক্যাডারভুক্ত না রাখার সুপারিশ করা হবে। এই ইস্যুতেই এখন প্রশাসন ও অন্য ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা মুখোমুখি অবস্থানে আছেন। বর্তমানে বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের শতকরা ৭৫ ভাগ ও অন্য সব ক্যাডারের শতকরা ২৫ ভাগ কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া হয় প্রশাসনে। বিতর্কের মাঝেই উপসচিব পদে পদোন্নতিতে শতভাগ দেওয়ার দাবি করছে প্রশাসন ক্যাডার। বিপরীতে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা চান মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতি।

এদিকে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় গত মঙ্গলবার এক আদেশে সরকারি আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডার দ্বন্দ্ব এখন সচিবালয়ের চার দেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। ফেসবুকে ২৫ ক্যাডার নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওএসডি সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজকে গত ৩০ ডিসেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। এ ছাড়া অসদাচরণের অভিযোগে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম ও ঢাকায় সংযুক্ত উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্যের জেরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হলে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থান ও হুঁশিয়ারির পর পরই গতকাল কেবিআইতে ২৫ ক্যাডার সার্ভিস ‘জনবান্ধব সিভিল সার্ভিস বিনির্মাণে করণীয়: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেখানে ২৫ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সেক্রেটারিসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

ওই সভায় সারা দেশ থেকে বিভিন্ন দপ্তরের আট হাজারের বেশি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেন আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক কৃষিবিদ আরিফ হোসেন।
গতকালের বৈঠকে নেতারা পরামর্শ দেন, চূড়ান্ত সুপারিশ দেওয়ার আগে কেউ যেন কোনো ধরনের বিরূপ মন্তব্য না করেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাউকে হেয়প্রতিপন্ন না করেন। এ ছাড়া কোনো উসকানির ফাঁদে পা না দিতে এবং সহনশীল থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সবাইকে।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, অসমতা দূর করে একটি গতিশীল জনপ্রশাসনব্যবস্থা গড়তে সরকারকে সহযোগিতা করতে চায় ২৫ ক্যাডার। গতকালের বৈঠকে নেতারা বলেন, সব ধরনের কোটা বিলোপের মাধ্যমে মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়তে হবে। উপসচিব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিলসহ প্রশাসনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। নিজ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ নীতিনির্ধারণী পদে নিয়োগে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নিজেদের মতামতের প্রতিফলন দেখতে চান দাবি করে তারা বলেন, দক্ষ, পেশাদার ও গতিশীল সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি, মর্যাদাক্রম নির্ধারণসহ সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনতে হবে। নেতারা অভিযোগের সুরে বলেন, কেবল একটি ক্যাডারের কর্মকর্তা পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি পাবেন, আর অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পদ থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি পাবেন না, এটা আধুনিক প্রশাসনব্যবস্থায় হতে পারে না। আলোচকরা আরও বলেন, ২৫ ক্যাডার এই অনিয়ম দূর করার আহ্বান জানায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ সর্বক্ষেত্রে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখলেও ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বঞ্চিত। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তারা এই বঞ্চনা-বৈষম্য দূর করার দাবি জানান।

১৮ কোটি মানুষের কার্যকর জনসেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে স্ব-স্ব ক্যাডারের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়নের দাবি জানায় আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনের সব সেক্টরে একটি ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় পেশাদারত্বের অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। সে কারণে প্রশাসন কাঙ্ক্ষিত জনসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত রেখে শুধু একটি ক্যাডারের নিয়মিত ও ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়ার বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় গতকালের ওই সভায়।

প্রশাসন ও অন্য ২৫ ক্যাডারের দ্বন্দ্ব কীভাবে দেখেন- জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘তারা যা করছে, এগুলো ভালো না। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সতর্কবার্তা দিয়েছে এবং কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। তাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনামতো সবার চলা উচিত।’

একই বিষয়ে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং বিপিএটিসির সাবেক রেক্টর আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘এটা কারও জন্যই শোভন ও যৌক্তিক নয়।

সংস্কার কমিশন যা বলছে, তা ঠিক নয়। কারণ এত প্রাথমিক পর্যায়ে এই কথা বলা ঠিক হয়নি। কমিশনের মূল কাজ সিভিল সার্ভিসের মান কীভাবে উন্নত করা যায়। তাদের উচিত দুর্নীতি বন্ধ করা ও দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়ে সুপারিশ দেওয়া। এটা ওনারা হয়তো বলতে পারতেন, তবে এভাবে আকস্মিকভাবে বলাটা তাদের প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ হয়নি। তাদের বোঝা উচিত ছিল এমন বক্তব্যে সমস্যা তৈরি হবে। তারা তো সুপারিশ করবেই। এখন সরকার তা শুনতেও পারে আবার নাও পারে। তাই কমিশনের কথা ধরার কিছু ছিল না। বিপরীতে যারা প্রতিবাদ করছেন বা আন্দোলন করছেন তারাও যৌক্তিকভাবে করছেন না। কারণ কমিশন এখনো সুপারিশ দেয়নি। সেটি এখনো সরকারের কাছে যায়নি। সরকার কী করবে না করবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তার পরও সবাই যেভাবে এখন উঠে-পড়ে লেগেছে- এর কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।’

Sharing is caring!