প্রজন্ম ডেস্ক:
সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও স্বাভাবিক হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। গত ৫ আগস্টের পর জনতার রোষানলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশ বাহিনী। মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপর্যাপ্ততার সুযোগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, আধিপত্য বিস্তার, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে খুন। ঘটছে ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে আতঙ্কে দিন কাটছে রাজধানীসহ পুরো দেশবাসীর।
মহাসড়কেও বেড়েছে ছিনতাই-ডাকাতি। মাদক কারবার পরিচালনায় ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। এদিকে এলাকায় এলাকায় নতুন করে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সবদিক থেকেই যেন অপরাধ ও অপরাধীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এতে রাজধানীসহ দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধসহ অপরাধ দমনে টহল দিতে রাজধানীসহ দেশের থানাগুলোতে প্রয়োজনীয় গাড়ি যোগ করা হলেও এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশকে।
ছিনতাই ঠেকাতে না পেরে সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী সতর্কভাবে রাস্তায় ফোন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। মোবাইল ছিনতাই আশঙ্কাজনভাবে বাড়ার কারণে সতর্কভাবে রাস্তায় ফোন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, মাদক বৃদ্ধির কারণে ছিনতাই বাড়ছে। সামাজিক আন্দোলন করে এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। পুলিশের একার পক্ষে মাদক নির্মূল করা সম্ভব নয়।
কমিশনারের এ বক্তব্যের পর সমালোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নগরবাসী প্রশ্ন তোলে, তা হলে কি পুলিশ ছিনতাই ঠেকাতে ব্যর্থ? এদিকে ডিএমপি কমিশনার সম্প্রতি আরেক বক্তব্যে বলেছেন, পটপরিবর্তনের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। এটি আমরা উতরে উঠেছি। সাড়ে চার মাসের বেশি সময় পর সেই মনোবল পূর্বের জায়গায় ফিরে এসেছে। তবে কমিশনারের এ বক্তব্যের আশানুরূপ ফলাফল আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দেখা যাচ্ছে না। আবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সম্প্রতি বলেছেন, অপরাধ কমাতে পুলিশের কাছে ওইভাবে কোনো ম্যাজিক নেই। অপরাধ কমাতে ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারেও খুনের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে ৩ মাসে সাত খুনের ঘটনা ঘটলেও এখনও সেখানে মাদকের কারবার চলছে প্রকাশ্যে। এদিকে শুধু জামিনে বের হওয়াই নয়, এতদিন আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে। আধিপত্য বিস্তারে বিভিন্ন এলাকায় মহড়া থেকে শুরু করে দখল, চাঁদা চেয়ে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। জামিনে বের হয়ে রাজধানীতে জোড়া খুনের সম্পৃক্ততার অভিযোগে শীর্ষ সন্ত্রাসীর পিচ্চি হেলালের নামে মামলাও হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাকে সাড়ে ৩ মাসেও গ্রেফতার করতে পারেনি।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় দেশের কারাগার থেকে পলাতক সাতশর মতো আসামি এখনও অধরা। এর মধ্যে ৭০ জন জঙ্গি ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে। কারাগার থেকে এখন পর্যন্ত আলোচিত ১৭৪ জন আসামিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীও মুক্তি পেয়েছে। তথ্য বলছে, ৫ আগস্টে থানা থেকে লুট হওয়া অনেক অস্ত্রই এখনও সন্ত্রাসীদের হাতে। আইনশৃঙ্খলা অবনতির বড় একটি কারণ জামিনে বের হওয়া সন্ত্রাসীরা। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে দায়সারা বক্তব্য পাওয়া গেছে। পুলিশ হেডকোর্য়ার্টারের ভাষ্য, যে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
তথ্য পর্যালোচনা
পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে আগস্টে ৬১৮টি, সেপ্টেম্বরে ৫৮৩টি, অক্টোবরে ৩৯৯টি, নভেম্বরে ৩৩৭টি খুনের ঘটনা ঘটে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২৩৬টি ডাকাতির, ৫৬৫টি ছিনতাই-দস্যুতার, ২৮৭টি অপহরণ, ১০২টি দাঙ্গা, ৩ হাজার ২০৯টি চুরির ঘটনা, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ ৭ হাজার ৩৬৪টি, চোরাচালানের অভিযোগে ৮৮৯টি, মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় ১৪ হাজার ৮৯৫টি এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ৫৭৮টি মামলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের ২২৪টি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশের আরও ২৩৬টি স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। থানায় হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের কারণে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়েছে, এ ছাড়া লুটপাট হয়েছে পুলিশের অস্ত্র-গোলাবারুদ।
লুট হওয়া এসব অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হলেও এখনও প্রায় দেড় হাজারের মতো অস্ত্র ও আড়াই লাখের বেশি গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি। এসব অস্ত্র এখনও রয়ে গেছে অপরাধীদের কাছেই। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা-ফাঁড়িসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদ লুট হয়। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৫৬টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। তবে এখনও ১ হাজার ৪১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৫৩টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি। লুট হওয়া এসব আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।
আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক) ডিসেম্বর মাসের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর মাসে ৫২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন ৫৮৭ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। এ সময় ধর্ষণের ২৩টি ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। এ ছাড়া যৌন হয়রানি শিকার হয়েছেন ১২ জন। সহিংসতার শিকার হয়েছে ৩৯ শিশু। হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৫১ শিশুর। মব জাস্টিস বা জনতার তাণ্ডবে খুন হয় ১৪ জন, এর মধ্যে ১০ জনই ঢাকার। এ সময় ১২ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৫৭টি বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১০টি ব্যবসাকেন্দ্রে হামলা, ৭টি মন্দিরে হামলা, ১টি উপাসনালয়ে আগুন এবং মূর্তির ওপর ১৪টি হামলা হয়। এসব ঘটনায় ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজধানীতে প্রথম দিনেই তিন খুন
রাজধানীতে নতুন বছরের শুরুতেই তিনটি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মঙ্গলবার ৩১ ডিসেম্বর দিনগত রাতে অর্থাৎ বছর শুরুর প্রথম প্রহরেই রাজধানীর মিরপুরের ভাসানটেক এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আলাউদ্দিন মন্টু (২২) নামে এক যুবক গুলিতে নিহত হয়েছে। পুলিশ জানায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় হিটু বাবু নামে কথিত এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে আলাউদ্দিন নিহত হয়েছে। প্রায় একই সময়ে রাজধানীর লালবাগের জেএন সাহা রোডের লিবার্টি ক্লাবের সামনে থেকে মাহবুব আলম (৩২) নামে এক যুবকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মাহবুব হত্যাসহ দুই মামলার আসামি ছিল। এদিকে রাজধানীর গাবতলী এলাকায় মুকুল শেখ (৩৭) নামে এক দিনমজুরকে পিটিয়ে হত্যা অভিযোগ পাওয়া যায়। বুধবার রাত ৮টার দিকে গাবতলী দ্বীপনগর এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাইকারী
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, শাহ আলী, এমনকি গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। মূলত সন্ধ্যা নামার পর বাড়ে ছিনতাই আতঙ্ক। এসব ঘটনায় প্রায়ই গুরুতর আহত, এমনকি প্রাণহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ডিএমপি ও পুলিশের তথ্যমতে, ঢাকা শহরসহ সারা দেশে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। পুলিশের দেওয়া তথ্য শুধু মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। তবে কিন্তু ছিনতাইয়ের প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি। যার বেশিরভাগই থানায় নথিভুক্ত হচ্ছে না। অধিকাংশ ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করছেন না, কেউ কেউ হারানো বলে জিডি করছেন। যারা শারীরিকভাবে জখম, মারধর কিংবা নিহতের মতো ঘটনা ঘটছে, কেবল সেসব ক্ষেত্রে হচ্ছে মামলা বা অভিযোগপত্র জমা পড়ছে। গত ১ ও ২ ডিসেম্বর ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দুই ব্যক্তি আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন মো. কাজল আহমেদ (৪৮) ও রাজন বর্মণ (১৭)। রাজধানীর খিলগাঁও ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ঘটনাগুলো ঘটে। গত ৩১ ডিসেম্বর সকালে সিলেটের সাত্তার আলী পাঁচ বছর পর সৌদি আরব থেকে ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমানবন্দরে গাড়িতে ওঠার আগে তাকে চারজন মিলে জিম্মি করে বেধড়ক মারধর করে। এ সময় তার কাছে থাকা বাংলাদেশি ১০ লাখ টাকা সমমূল্যের ৩০ হাজার রিয়াল ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। গত ১৮ নভেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছিনতাইয়ের শিকার হন রবিউল মিল্টন নামে এক যুবক।
তিনি জানান, অজ্ঞাতনামা ৫ জনের একটি দল আদাবর এলাকা থেকে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এ সময় চাপাতি দিয়ে তার মাথায় দুটি, চাপাতির উল্টো পাশ দিয়ে বাম পায়ের পেছনে হাঁটুর উপরে এবং ডান হাতের কব্জিতে আঘাত করে। এদিকে গত ১৬ ডিসেম্বর রাতের একটি ছিনতাইয়ের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, রাজধানীর আসাদ গেট এলাকায় যানজটে স্থবির সড়কে চাপাতি হাতে ঘুরছে তিন যুবক। একপর্যায়ে একটি প্রাইভেটকারের জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন নিয়ে যায় তারা।
পুলিশ ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৫টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে ছিনতাইয়ের কোনো জিডির তথ্য নেই পুলিশের কাছে। ৫ আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছে সাতজন। গুরুতর জখম হয়েছে আরও বেশ কয়েকজন। শুধু সাধারণ মানুষ না, ছিনতাইয়ের শিকার সাংবাদিকরাও। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ঢাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে খুইয়েছেন ক্যামেরা, মোবাইল, টাকা আর ব্যাগ। হয়েছেন জখমও। গত ১৬ ডিসেম্বর ছুটির দিন সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মফিজুল ইসলাম সাদিক। তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আজিবুল হক পার্থও ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতের শিকার হন। গত ২২ ডিসেম্বর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডসংলগ্ন লেকের পাড়ে এ ঘটনা ঘটে। রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছেন খোদ রিপোর্টারদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল। গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে কর্মস্থল দৈনিক ইনকিলাব থেকে ফেরার পথে মতিঝিলে এ ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীরা তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় হাত ও পায়ে জখম হয়। গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে দৈনিক সময়ের আলোর সাংবাদিক আবদুল কাইয়ুম ছিনতাইয়ের শিকার হন। এ সময় তিনি একটি দামি মোবাইল ও সাড়ে ৫ হাজার টাকা খুইয়েছেন। এ ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সম্প্রতি সময়ে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন। এদিকে দিনের আলোয় ৩ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর ঝিগাতলায় সীমান্ত স্কয়ার শপিং মলের একটি স্বর্ণের দোকানে চুরির ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকার বাইরেও প্রতিদিন ঘটছে হত্যা
গত ২ জানুয়ারি মেহেরপুরের গাংনীতে নিখোঁজ হওয়ার ১২ ঘণ্টা পর আলমগীর হোসেন (৩৮) নামের এক যুবদল নেতার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সহড়বাড়ীয়া-কামারখালী মাঠ থেকে হাত-পা বাঁধা গলা কাটা অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে গাংনী থানা পুলিশ। মরদেহের পাশ থেকে হত্যার কারণসংবলিত হাতে লেখা একটি চিরকুট পাওয়া যায়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ক্ষত রয়েছে। এ ছাড়াও গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। ৩ জানুয়ারি জয়পুরহাটরে কালাইয়ে নিখোঁজের ২০ ঘণ্টা পর আলু ক্ষেত থেকে আবদুল মালকে খান ফটু (৬৫) নামে এক বৃদ্ধরে মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমার বাবা বৃহস্পতবিার বিকালে মোটরসাইকলে নিয়ে বের হয়। কে বা কারা আমার বাবাকে হত্যা করে মরদেহ আলুক্ষেতে ফেলে গেছে। ২ জানুয়ারি সীতাকুণ্ডরে সলমিপুরে মীর আরমান হোসনে (৪৮) নামে এক বিএনপি নেতাকে ফোন করে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে এক অজ্ঞাতনামা নারীর অর্ধগলতি মরদেহ পরিত্যক্ত টয়লটে থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ২ জানুয়ারি সাভারের আশুলিয়ায় কাদামাটিতে চাপা অবস্থায় মাহামুদুর রহমান হৃদয় নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্বজনদের বরাতে পুলিশ জানায়, গত ৫ দিন আগে ওই যুবক বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। ৩ ডিসেম্বর ফরিদপুরে হুসাইন নামে ১৩ বছরের এক কিশোর অটোরিকশা চালকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয়রা জানায়, দড়ি দিয়ে গলায় প্যাঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে করে হত্যা করা হয়েছে হুসাইনকে। ৩০ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে গড়াই নদের বালুচর থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃত ব্যক্তির বাঁ হাত ভাঙা, মুখ ও পায়ে ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়।
এদিকে পুলিশের অফিসে ঢুকে হুমকির ঘটনাও ঘটেছে। ময়মনসিংহে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক আশরাফুর রহমান চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় তার সামনে হইচই করেন বেশ কয়েকজন। কেউ উচ্চৈঃস্বরে ধমকান, কেউবা অভিযোগ করেন, আবার কেউ প্রশ্ন করে জবাব চাইছেন। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। ঘটনাটি গত ২৯ ডিসেম্বরের, যা নিয়ে আলোচনা গড়িয়েছে পুলিশ সদর দফতর পর্যন্ত। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। ডিআইজি আশরাফুর রহমানের ভাষ্য, জাসদ নেতা এক সিটি কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম করে কিছু লোকজন তার কক্ষে ঢুকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ময়মনসিংহের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক গোকূল সূত্রধর মানিক বলছেন, তাদের কেউ সেখানে যায়নি।
পুলিশ হেড কোয়ার্টারের ভাষ্য
পুলিশ সদর দফতরে মিডিয়া অ্যান্ড পিআর বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘এটা আমাদেরও কনসার্ন যে এটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে, আমরা অপরাধ দমনে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ অপরাধ ক্রমেই বাড়ছে, তবে পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ার কারণেই কি দমন করা যাচ্ছে না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না না বিষয়টি এমন না। মনোবলের বিষয়ে আমরা দ্রুতই নজর দিয়েছি, বলা যায় পুলিশের মনোবল ফিরে এসেছে, আমরা কাজ করছি। কিন্তু অপরাধের ট্রেন্ড তো এমনই, কখনো বারে, কখনো কমে। আমাদের চেষ্টা হচ্ছে যে অপরাধকে কীভাবে আরও কমিয়ে নিয়ে আসা যায়। আমরা সেজন্য কাজ করছি। আশা করছি, খুব দ্রুতই এর দৃশ্যমান ফলাফল পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, মব জাস্টিস হয় বিভিন্ন জায়গায়। এটিও কিন্তু সামাজিক সচেতনতার একটি বিষয়। যেই অপরাধী হোক তাকে আইনের কাছে সোপর্দ করতে হবে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। কারণ যে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে তাকেও শাস্তির আওতায় আনা হবে।
বিশেষজ্ঞের ভাষ্য
গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে পুলিশের নৈতিক ও পেশাগত মনোবলের যে সংকট তৈরি হয়েছে, এটি রাতারাতি পূরণ হবে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, পুলিশ এখন অনেকটাই এডহক ভিত্তিতে কাজ করছে। অর্থাৎ কোথাও সমস্যা তৈরি হচ্ছে, পুলিশ অন্য জায়গা থেকে মনোযোগ সরিয়ে সেখানে কাজ করছে। আবার কোনো জায়গাতে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেখানে ব্যবস্থা নিতে হয়তো একটু বিলম্ব হচ্ছে। তো এরকম এডহক ভিত্তিতে কাজ করতে গেলে অপরাধীরা নানাভাবে সুযোগ নেবে। এখন সেটাই হচ্ছে।
সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আইজিপি বললেন, অপরাধ দমনে তাদের হাতে কোনো ম্যাজিক নেই। আসলে পৃথিবীর কোনো দেশের পুলিশের হাতে ম্যাজিক নেই। সব দেশের পুলিশই বাস্তবতার নিরিখে অপরাধের ধরন, বৈশিষ্ট্য ও আইনি প্রক্রিয়াগুলোকে বিবেচনা করে নানা ধরনের প্রস্তাব বা পদক্ষেপ নিয়েই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখে।’ তিনি বলেন, ‘যখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে কিছুটা নিষ্ক্রিয়তা থাকবে, ঘাটতি থাকবে তখন মাদক, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, চুরি ছিনতাই, ডাকাতি অপহরণের মতো অপরাধ বাড়তে থাকবে। একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল।
Sharing is caring!