প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৭ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

শর্ষের ভূত প্রশাসনে!

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ৩, ২০২৫, ০৯:১৯ পূর্বাহ্ণ
শর্ষের ভূত প্রশাসনে!

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ মাসেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তাদের দোসর হিসেবে চিহ্নিত সরকারি কর্মকর্তাদের‌ বিরুদ্ধে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা প্রায়ই বলে আসছেন, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তাঁবেদার কর্মকর্তাদের বিচার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন এখনও হয়নি। বিগত সরকারের ১৫ বছরে বঞ্চিত কর্মকর্তারা এখনও ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়, আর তখনকার সুবিধাভোগীরা এখনও বহাল রয়েছেন প্রশাসনের উচ্চাসনে। বরং দিনে দিনে তাদের মধ্যে ‘ড্যাম কেয়ার’ ভাব যেন আরও প্রকট হচ্ছে। এসব দেখেশুনে ক্রমেই হতাশা বাড়ছে বঞ্চিতদের মনে। তারা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের যে মূল আকাঙ্ক্ষা সেটা মাথায় রেখে দ্রুত এই পরিস্থিতি থেকে প্রশাসনকে মুক্ত করার দাবি জানান। শর্ষের ভেতরেই লুকিয়ে থাকা ভূত তাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিসিএস প্রশাসন ও ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদপদবি, মানমর্যাদাসহ বিভিন্ন দাবিতে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সুবিধাভোগীদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঞ্চিতদের উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ থেকে বিএনপি-জামায়াতপন্থি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়ে সুবিধাভোগীদের পদায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জন সাবেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। এর মধ্যে ১১৯ জনকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার এবং বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ থাকলেও সেটি এখন থমকে আছে। আগামী ১১ জানুয়ারি থেকে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।

গত মঙ্গলবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ঘোষিত ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারগুলোতে এখনও খুনির দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। সচিবালয় হোক বা যেকোনো জায়গা থেকে ষড়যন্ত্র করলে আমরা তাদের উৎখাত করে ছাড়ব। গোপালগঞ্জে এখনও কীভাবে আমাদের ভাইদের ওপর হামলা হয়? যদি আমাদের নিরাপত্তা না দিতে পারেন, তাহলে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারগুলোতে আপনাদের আর বসিয়ে রাখব না।

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সচিবালয়ের ভেতরে দালালগুলো ঘাপটি মেরে আছে। পুলিশ প্রশাসনে অসংখ্য দালাল ঘাপটি মেরে আছে। হাসিনা সরকারের পতনের ৫ মাস পার হয়েছে। কিন্তু এখনও জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আমরা দেখতে পাইনি। এই বিপ্লবের স্বীকৃতি আমরা চাই। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দ্রুততম সময়ে আমরা দেখতে চাই। অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে চার মাসে একের পর এক বিষয় নিয়ে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। পদোন্নতি, পদায়নসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের। নিয়মিত (রুটিন) কাজ ছাড়া নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে পারছে না প্রশাসন।

 

প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নাগরিক সেবা সহজ করা, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের গতি বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে তেমন নজর দেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার আরেকটি উদাহরণ হলো, কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করে আবার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। তদবির করে কেউ কেউ বদলির আদেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। আবার সমন্বয়হীনতার কারণে বদলির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে সরকারকে। এতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। গত ১১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মিজ শেখ মোমেনা মনিকে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বদলি করে ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে যোগদান করতে বলা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত ওই আদেশ প্রত্যাহার করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গত ১৮ নভেম্বর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) গাজী মো. সাইফুজ্জামানকে ওএসডি করা হয়। পরে সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের কর্মসূচির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৩০ এ নং বিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়নে যাচ্ছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছে, কেউ এই বিধি লঙ্ঘন করলে তিনি অসদাচরণের দায়ে ব্যবস্থার আওতায় আসবেন। বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মচারীর বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ বিবিধ কর্মসূচি পালনের কারণে সরকারি কর্মচারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে উল্লেখ করে কর্মচারীদের শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

 

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সভাপতি ড. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, ফ্যাসিবাদের দোসররা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবে আর বঞ্চিত কর্মকর্তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন তাদের কারণে প্রশাসনে অস্থিরতা কমছে না। তারা ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন করছে। ওই দোসররা স্বৈরাচারের আমলে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে।

 

অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তারা এখনও পদোন্নতি পাননি। এজন্য বঞ্চনার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। সুপরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) পদোন্নতির বিষয় নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

 

তাই বঞ্চিতদের হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই কর্মকর্তা জানান, দ্রুত তাদের পদোন্নতি হয়ে যাবে বলে তিনি আশা করেন।

 

কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ বলছে, সরকারি দায়িত্ব পালনের কারণে অনেক সময় বিগত সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশ নিতে হয়েছে। ওইসব মিটিংয়ের ছবি এখন অনেকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ওই ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, তিনি স্বৈরাচারের দোসর। যে কারণে অধিকাংশ কর্মকর্তার মনে কোনো শান্তি নেই। তারা আরও জানান, যারা বিগত সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যারা কোনোভাবেই সুবিধাভোগী না, তাদের আতঙ্কিত থাকা প্রশাসনের জন্য কল্যাণকর কিছু বয়ে আনবে না।

 

 

গত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনপ্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে কিছু সুপারিশের সিদ্ধান্তের কথা জানান। যেমন উপ সচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতির আনুপাতিক হার ৫০:৫০ করা অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ পদোন্নতি এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে একই হারে পদোন্নতির কথা উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া উপ সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের আদলে আলাদা সার্ভিস হিসেবে নিয়ে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশের কথাও জানান তিনি। কমিশনপ্রধানের এমন বক্তব্যের পর থেকেই মূলত ক্যাডার সংগঠনগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভেদ ও অস্থিরতা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট।

 

এই সরকারের ৫ মাসেও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি।

Sharing is caring!