প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২১শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৫ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

হাজারও পণ্যের দাম বাড়বে

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ৩, ২০২৫, ০৮:১০ পূর্বাহ্ণ
হাজারও পণ্যের দাম বাড়বে

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ভ্যাটের হার বাড়ানোর ফলে হাজারের বেশি পণ্যের দাম আরও একধাপ বাড়বে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতেই এই পদক্ষেপ। ভ্যাট বাড়লেও নিত্যপণ্য এ তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়েছে। তাই নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না।

এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড করেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাটের হার বাড়িয়ে পণ্যমূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

উপদেষ্টা পরিষদের এ সিদ্ধান্ত কবে নাগাদ কার্যকর হবে জানতে চাওয়া হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। ভেটিং শেষে অচিরেই রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে।

 

প্রস্তাবের প্রভাব

 

ভ্যাটের হার বাড়ানোয় ভ্যাট অব্যাহতি কমানো বা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে রেস্তোরাঁয়, পোশাক কেনায় খরচ বাড়বে। তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিল বাড়বে। মিষ্টি কিনতে গেলেও খরচ বাড়বে। উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপারে খরচ বাড়বে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোয় খরচ বাড়বে।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে ভ্যাট বসবে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে, এমন খাতগুলোতে ভ্যাট আরোপ হবে। উৎপাদন খাতে পোশাকশিল্পেও ভ্যাট আসবে। রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, লিফট, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ভ্যাট বাড়বে। ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে ভ্যাট বাড়বে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য যেমন- কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড এজাতীয় পণ্য উৎপাদনে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে ভ্যাট বাড়বে। পলিব্যাগের পরিবর্তে জিওব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করতে কাঁচামাল হিসেবে পিপি ও পিপি স্ট্যাপল ফাইবার, রিসাইক্লিংয়ের লক্ষ্যে ওয়েস্ট পেপার/কটন/পুরোনো ব্যাটারি/স্ক্র্যাপ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও ফটো-ভোল্টাইক, সেলে ভ্যাট বাড়বে। পরিবহনসেবায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পণ্য পরিবহন ও সাধারণ যাত্রী পরিবহনসংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভ্যাট বাড়বে। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর প্রথম তফসিল অনুযায়ী ৪৮৯ এইচএস কোডভুক্ত প্রাথমিক পণ্য, জীবনধারণের জন্য মৌলিক পণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়বে। এ ছাড়া একই তফসিল অনুযায়ী প্রায় ৫০টি সেবার ওপর ভ্যাট বাড়বে। ৫০০ পণ্যে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট বাড়বে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৪৩ শতাংশ পণ্যে ভ্যাট বাড়বে।

 

কবে কার্যকর

এনবিআর ভ্যাট নীতি শাখার সদস্য মো. বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক কারণে বা প্রভাবশালীদের তদবিরে বিভিন্ন সময়ে রাজস্ব অব্যাহতি দেওয়া হলেও তার অনেকগুলোই এখন আর প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন মহল থেকে রাজস্ব অব্যাহতি কমানোর চাপ আছে। অনেক দিন থেকেই এসব নিয়ে কাজ চলছে। এবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার বা কমানোর ফলে ভ্যাটের হার বাড়বে। এতে অনেক পণ্যের ওপর নতুন করে ভ্যাট যোগ হয়েছে। মোটাদাগে বলা যায়, বেশ কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়বে। উপদেষ্টা পরিষদে এসব সিদ্ধান্ত আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ে আছে। ভেটিং শেষে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এ মাসের মধ্যেই জারি করার কথা আছে।

 

অর্থ উপদেষ্টা কী বলছেন

বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। যেসব জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছি, এগুলো আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।

গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘তিন তারকার ওপরে যে রেস্টুরেন্টগুলো, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। থ্রেসহোল্ড আছে, যাদের টার্নওভার ৫০ লাখ টাকার ওপর, তাদের ক্ষেত্রে এটা আসবে। অন্য কোনো ব্যবসা তো এটার মধ্যে আসছে না।’

বিমান ভাড়ার ক্ষেত্রে কী ভ্যাট বাড়ছে- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘বিমানের ভাড়ার ক্ষেত্রে আগে ৫০০ টাকা ছিল, সেটি এখন ২০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিমানে এখন লোকজন মোটামুটি চড়ে। তারা ২০০ টাকা বেশি দিতে পারবে না বলে মনে হয় না। পৃথিবীর যেকোনো দেশ যেমন- নেপাল-ভুটান ধরুন, এত লো ট্যাক্স কোথাও নেই। এসেন্সিয়াল জিনিসের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় বলেছি, সেখানে আমরা প্রায় জিরো করে নিয়ে আসব। চূড়ান্তভাবে ভোক্তা ১৫ শতাংশ ট্যাক্সও দিচ্ছে না।’

অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ মাস পর এই সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছে- এ বিষয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা করার কারণটা হলো যে ছাড় দিয়েছি, সেটা হিসাব করে… কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের রাজস্ব গ্যাপ এত বেশি, আমি তো আর বড় করে ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং করে এগোতে পারব না।’

 

আইএমএফের সুপারিশ ও বাড়তি ভ্যাট আদায়

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে প্রতি অর্থবছরে শুধু আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় সরকার গড়ে ৪৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় করে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভ্যাট অব্যাহতিতেও এ অর্থের সমান কম আদায় হয়েছে। তাই এখানেই হাত দিয়েছে ঋণদানকারী সংস্থাটি। ভ্যাট অব্যাহতি তুলে নেওয়া বা প্রত্যাহার করায় এ পরিমাণ অর্থ আদায় হবে। ঋণের কিস্তি পাওয়ার শর্ত হিসেবে আইএমএফ ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের একটি মিশন। চলমান এই ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয়েছে আইএমএফ। তবে এ জন্য কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। মূলত আইএমএফের শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

রাজস্ব খাতে সংস্কারের মাধ্যমে আইএমএফ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত ৮ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত দিয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজস্ব থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে বলেছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত আরও ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে।

আইএমএফের পরামর্শে এটি করা হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে গতকাল অর্থ উপদেষ্টা বলেন, না, সবদিক চিন্তাভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনে হয় না কষ্ট হবে। জনগণের স্বস্তি না পাওয়ার তো কোনো কথা নয়।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ধার করে বেশিদিন চলা যায় না। কর ও কাস্টমস ক্ষেত্রেও কি রাজস্ব বাড়তে পারে- জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার না করে বলেন, ‘এখন বলব না।’

 

প্রস্তাবের সমালোচনা

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার অর্থসংকটে আছে। বিভিন্ন পণ্য-সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে, রাজস্ব বাড়িয়ে আয় বাড়ানো চেষ্টা করছে। এতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ কিছুটা বাড়বে। তবে আয় বাড়াতে গিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ যেন কষ্টে না পড়ে তাও লক্ষ রাখতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ভ্যাটের হারের কারণে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে গেলে নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার যে ব্যবস্থা নেবে, সে রকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। সংকটের সমাধান করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ করে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

Sharing is caring!