প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২১শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৫ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

শৃঙ্খলার প্রশ্নে কঠোর হচ্ছে সরকার

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ১, ২০২৫, ০১:৩৯ অপরাহ্ণ
শৃঙ্খলার প্রশ্নে কঠোর হচ্ছে সরকার

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

সরকারি চাকরিবিধির তোয়াক্কা না করে দাবি আদায়ে কর্মসূচি পালন করে ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা। আবার বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়ম ভেঙে গত রবিবার সচিবালয়ে সমবেত হয়ে শোডাউন করেছেন। অন্য ক্যাডারগুলোর কর্মকর্তারা পাল্টা হিসেবে গত মঙ্গলবার কলম বিরতির নামে এক ঘণ্টা কাজ থেকে বিরত থাকার কর্মসূচি পালন করে আসছেন। দুই পক্ষই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া সুপারিশ নিয়ে বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে এত দিন সরকার নীরব থাকলেও এবার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানা গেছে, প্রশাসনের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৩০-এ নং বিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছে, কেউ এই বিধি লঙ্ঘন করলে তিনি অসদাচরণের দায়ে ব্যবস্থার আওতায় আসবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে।

 

জানা যায়, পদ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত দাবিতে জনপ্রশাসনে এখন দুটি পক্ষ মাঠে রয়েছে। তাদের মধ্যে একদিকে আছে প্রশাসন ক্যাডার, অন্যদিকে আছে ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। মূলত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ আলোচনায় আসার পর থেকে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের দাবি নিয়ে প্রতিবাদ সভা, জমায়েত, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সরব বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের ৩ জানুয়ারি সমাবেশ করার কথা রয়েছে।

 

সূত্র বলছে, বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু কর্মচারীর এসব কর্মসূচি পালনের কারণে সর্বস্তরের সরকারি কর্মচারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ কথা উল্লেখ করে কর্মচারীদের শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় থেকে ‘সরকারের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৩০-এ নং বিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি যথাযথভাবে অনুসরণ সংক্রান্ত’ এক বিজ্ঞপ্তিতে এ হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। উপ সচিব কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জনসেবা প্রদান এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকারি কর্মচারীগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সরকারি কর্মচারীদের সুশৃঙ্খল, দায়িত্বশীল ও পেশাদার আচরণের ওপর জনপ্রশাসনের সফলতা নির্ভর করে। সম্প্রতি বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মচারীর বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ বিবিধ কর্মসূচি পালনের কারণে সরকারি কর্মচারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ‘ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে, সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, আদেশ বা সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার আগেই বিবেচ্য বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপ মন্তব্যসহ বিবৃতি প্রকাশ করা হচ্ছে, যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর পরিপন্থি। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৩০-এ নং বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী-(এ) সরকারের অথবা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ পালনে জনসম্মুখে আপত্তি উত্থাপন করিতে বা যেকোনো প্রকারে বাধা প্রদান করিতে পারিবেন না, অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিকে তাহা করার জন্য উত্তেজিত বা প্ররোচিত করিতে পারিবেন না। (বি) সরকারের বা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ সম্পর্কে জনসম্মুখে কোনো অসন্তোষ্টি বা বিরক্তি প্রকাশ করিতে অথবা অন্যকে তাহা করার জন্য প্ররোচিত করিতে অথবা কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিতে বা অন্যকে অংশগ্রহণ করার জন্য প্ররোচিত করিতে পারিবেন না। (সি) সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ পরিবর্তন, বদলানো, সংশোধন বা বাতিলের জন্য অনুচিত প্রভাব বা চাপ প্রয়োগ করিতে পারিবেন না। (ডি) সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বা কোনো শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যেকোনোভাবে অসন্তোষ্টি, ভুল বুঝাবুঝি বা বিদ্বেষের সৃষ্টি করিতে অথবা অন্যকে প্ররোচিত করিতে বা সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারিবেন না।’

আরও বলা হয়, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর যেকোনো বিধান লঙ্ঘন সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর আওতায় অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী এ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অসদাচরণের দায়ে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আওতায় আসবেন। সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর।

সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন প্রশাসন এবং ২৬ ক্যাডারের অনেকেই। তারা এখনও আরও সুবিধা চাইছেন। এসব দেখে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও গাড়ি ও সুদমুক্ত ঋণের মতো সুবিধা চাইছেন। চাপ দিয়ে পদোন্নতি, পদায়নের সিদ্ধান্ত বদল করা হচ্ছে। এতে প্রশাসনে অস্থিরতা, অচলাবস্থা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর না হওয়ায় তা দূর হচ্ছে না।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার ২(ই) ধারায় এমন আচরণকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেউ তা করলে সরকার তিরস্কার থেকে শুরু করে চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো শাস্তি দিতে পারবে।

জানা গেছে, জনপ্রশাসন সংস্কারে গঠিত কমিশন পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব এবং যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করবে। এর পর পরই বিধিমালা ভেঙে এর বিরোধিতায় নেমেছেন আমলারা। উপ সচিব থেকে ঊর্ধ্বতন পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ এবং অন্য ২৫ ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ পদায়নের সুপারিশ করা হবে বলে কমিশনপ্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী জানিয়েছিলেন। এর বিরোধিতা করছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। শতভাগ পদ প্রশাসন ক্যাডার থেকে পূরণের দাবিতে ফেসবুকে লিখেছেন অনেক কর্মকর্তা। কিন্তু সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারেও বিধিনিষেধ রয়েছে। তা না মেনে ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’গঠনের দাবিতে ফেসবুকে প্রস্তাবিত লোগো পোস্ট করছেন। পরে তারা সচিবের সঙ্গে দেখা করে দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। যদিও চাকরিবিধি অনুযায়ী, অবস্থান নেওয়া বা কর্মসূচি গ্রহণের সুযোগ নেই ক্যাডার কর্মকর্তাদের।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, যা কিছু করা হচ্ছে তা চাকরি বিধিমালার পরিপন্থি। তারা সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিতে পারেন, দেনদরবার করতে পারেন। এক ঘণ্টা কর্মবিরতি দেওয়া মানে এক ঘণ্টা জনগণ সেবা পাবে না। জনগণকে সেবাবঞ্চিত করার অধিকার তাদের কে দিল? প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যে সচিবের কক্ষের সামনে অবস্থান নিলেন এটিও একইভাবে সার্ভিস শৃঙ্খলা পরিপন্থি। আসলে ক্যাডার সার্ভিসের লোকজন সুবিধাভোগী। তিনিও সাবেক ক্যাডারের কর্মকর্তা হলেও এটা সত্য যে, সুবিধাভোগীরাও সুবিধা চাচ্ছেন।

Sharing is caring!