প্রজন্ম ডেস্ক:
টালমাটাল পরিস্থিতি ও পরিবর্তনের বছর শেষে ২০২৫ সালের প্রথম দিন আজ। সঙ্গত কারণেই নতুন বছরকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কারণ গত সাড়ে ১৫ বছরের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত ছিল দেশের জনগণ। সেই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম এবং অনেক প্রাণহানির পর দূর হয়েছে অগণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে দেশের আপামর জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা হলো একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফেরার। যে শাসনের মধ্যে থাকবে বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ। মুক্ত গণতন্ত্রে সংবাদপত্র তার স্বাধীনতা ভোগ করবে, বিচারব্যবস্থায় ফিরে আসবে নিরপেক্ষতা, প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে দলীয়মুক্ত হবে, এমনটাই প্রত্যাশা করে এ দেশের জনগণ। পরাধীনতার শিকল ভেঙে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এ কারণেই ’৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে বিজয় অর্জিত হয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশের জনগণের এমন আকাঙ্ক্ষারই অপমৃত্যু ঘটেছিল গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর পর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে, বিরোধী দলগুলো দমনপীড়নে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সব মিলিয়ে এককেন্দ্রিক শাসনে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। ২০২৪-এর সর্বশেষ আকাঙ্ক্ষা ৭ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে মানুষের গণতন্ত্রের জন্য মানুষের সর্বশেষ আকাঙ্ক্ষাটুকুও ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ওই ঘটনার পরে, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি এ দেশের জনগণের বড় অংশের মধ্যে তখন গণতন্ত্রের ব্যাপারে আর কোনো প্রত্যাশা অবশিষ্ট ছিল না। দেশের রাজনীতিতে আলোচনা ছিল ‘গাছের ডালপালা-পাতাও আওয়ামী লীগ করে।’
বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনের শক্তিও ক্রমশ কমে আসছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে কোটা নিয়ে আদালতের রায় এবং সরকারপ্রধান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের আক্রমণাত্মক মন্তব্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামেন। দেশের জনগণ আরেকবার ঘুরে দাঁড়াবার সাহস পায়। শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় আক্রমণ হতে থাকায় উদ্বিগ্ন অভিভাবক মহল একপর্যায়ে রাস্তায় নামে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। একপর্যায়ে সরকারের আজ্ঞাবহ বাহিনীগুলোর দমনপীড়নের ক্ষমতাও সীমিত হয়ে আসে। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল এ আন্দোলনে শামিল হয়। সেই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী জানিয়ে দেয় নিরপরাধ মানুষের ওপর তারা আর গুলি চালাবে না। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকার তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী মাঠে নামিয়েও আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এই আন্দোলনের তীব্রতায় আসে ৫ আগস্ট। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের চারদিকে জনস্রোত আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে সরকারের জন্য। ফলে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে চলে যান। জনগণ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন দখল করে নেয়। অবসান হয় সাড়ে ১৫ বছরের অগণতান্ত্রিক অপশাসনের।
শেখ হাসিনার বিদায়ের প্রায় পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হলেও দেশের জনগণ এখনো গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ স্বাদ পায়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। কিন্তু একটি দেশের গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনই জনগণের মতামত দেওয়ার একমাত্র সুযোগ। স্বাধীনতার আগে এবং পরবর্তী ৫৩ বছরে যতগুলো লড়াই-সংগ্রাম হয়েছে সবই এই গণতন্ত্রের জন্য। ছাত্রসমাজ কোটাবিরোধী ইস্যুতে মাঠে নামলেও শেষদিকে তারা শেখ হাসিনার পতন তথা গণতন্ত্রের পক্ষেই লড়াই করেছে।
গণতন্ত্রের পক্ষে অন্তরায় বা যেসব ব্যবস্থা ও বিধিবিধান রয়েছে, সেগুলো সংস্কার করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি গণতন্ত্রে ফেরা তারচেয়েও বেশি জরুরি। কারণ দেশের মানুষ মনে করে, শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন হলে শেখ হাসিনাকে এই পরিণতি ভোগ করতে হতো না। কারণ তখন জনগণের মধ্যে এত বেশি ক্ষোভ তৈরির সুযোগ ছিল না। ফলে গণতন্ত্রহীনতার ক্ষোভ থেকেই আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়েছে, এ কথা দেশে সর্বস্তরের মানুষ এখন স্বীকার করছেন। তারা বলছেন, গণতন্ত্র হত্যা করে শেখ হাসিনা নিজেও ডুবেছেন, দেশকেও ডুবিয়েছেন। অর্থনীতি ধস ও ভোটের রাজনীতির কবর দিয়েও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারেননি শেখ হাসিনা। তার সরকারের চরম পতন হয়েছে। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ গণতন্ত্রে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।
Sharing is caring!