প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২রা রজব, ১৪৪৬ হিজরি

পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ কী

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪, ১২:২৩ অপরাহ্ণ
পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ কী

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুবকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করে একদল শিক্ষার্থী ও বহিরাগত। এ সময় তিনি কলেজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই অবস্থায়ই তার হাতের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় পদত্যাগপত্রে। এর পর প্রায় দুই মাস ধরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকার একপর্যায়ে গত ২৩ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

শিক্ষক আইয়ুবের ভাগিনা টিপু বলেন, ‘ওই ঘটনার পর মামা আর কলেজে যাননি। সেদিন থেকে তিনি মানসিক টেনশনে থাকতেন। তবে আমাদের সঙ্গে এসব নিয়ে কিছুই বলতেন না। যেদিন মারা গেলেন, সেদিন সকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত। তার অবস্থা ভালো নয়। এর এক ঘণ্টা পর চিকিৎসক মামাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

 

শিক্ষক এসএম আইয়ুব হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তবে তার মতো পদত্যাগে বাধ্য হওয়া আরও অনেক শিক্ষক আছেন, যারা চাকরি হারিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দিনের পর দিন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে ছোটাছুটি করছেন, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত ও সমাধান পাচ্ছেন না। এসব শিক্ষকের ‘পদত্যাগের’ বিষয়টি আইনসঙ্গতভাবে সমাধা করার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই সরকারেরও। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু কী কাজ হচ্ছে, সে ব্যাপারেও রয়েছে ধোঁয়াশা।

 

পদত্যাগে বাধ্য করানো হলো কেন

 

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রধানসহ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে আন্দোলনে নামেন একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। এদের মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও অন্য কোনো শিক্ষক আওয়ামী লীগের পদধারী কিংবা সমর্থক ছিলেন, তাদের অনেককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কোনো কোনো শিক্ষককে আবার প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষই সাময়িক ও স্থায়ী অব্যাহতি দেয়। দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছেÑ এমন কিছু শিক্ষককেও পদত্যাগ করানো হয়। এর বাইরেও অনেক শিক্ষক আছেন, যারা পদত্যাগ না করলেও আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়ার আশঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত রয়েছেন।

এই পদত্যাগ কিংবা অব্যাহতিতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা খুব একটা সমস্যায় পড়েননি। তাদের ওই প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য কোনো স্থানের প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু বিপাকে পড়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। কারণ অব্যাহতি কিংবা বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করানোর পর তাদের বেতন বন্ধ রেখেছে সরকার ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। এতে চাকরি হারিয়ে মানসিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি আর্থিক সংকটেও তারা হাবুডুবু খাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরকারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও বেতনের একটা অংশ দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক জানান, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আর কয় টাকা বেতন পান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই বেতনে এমনিতেই চলা দায়। তার ওপর চার-পাঁচ মাস থেকে সে বেতনও বন্ধ। সব মিলিয়ে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা।

মৌলভীবাজারের একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, ‘কখনও সরকারি রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না। তবে স্থানীয় ও স্কুলের কিছু শিক্ষকের অনৈতিক নানা সুবিধা না দেওয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর তাদের চক্রান্তে আমাকে প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বেতনও আটকে দেওয়া হয়েছে। একদিকে দুই সন্তানের পড়ালেখার খরচসহ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি, অন্যদিকে ব্যাংকে একটি ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছি না। চোখে শর্ষে ফুল দেখছি।’

 

কত শিক্ষককে পদত্যাগ করানো হয়েছে

 

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঠিক কতজন শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছেÑ তার কোনো হিসাব নেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে। মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, ‘কতজন শিক্ষককে অব্যাহতি কিংবা পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়েছে, সে তালিকা করা হয়নি। তবে তা তৈরি করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিলে এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

এদিকে রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোর করে পদত্যাগ, অপসারণ, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক ছুটি নিতে বাধ্য হওয়া শিক্ষকরা মিলে করেছেন ‘পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষক জোট’। জোটটি জানিয়েছে, ‘আন্দোলনের পর ন্যূনতম দুই হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। যার মধ্যে ৯৫ শতাংশই প্রতিষ্ঠানের প্রধান।’

এই জোট গড়ে ওঠার পর থেকে পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের এমপিও থেকে নাম কর্তন না করে বেতন-ভাতাদি চালু রাখার; পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ অপসারণ, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক ছুটি বাতিল ঘোষণার; সসম্মানে স্বপদে বহাল করে কর্মস্থলের নিরাপত্তা বিধানের; দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বার্থলোভী ও শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার এবং পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের সমমানের এমপিওভুক্ত স্কুলে শূন্যপদে বদলির ব্যবস্থা করার দাবিতে আন্দোলন করছে।

তারা ইতোমধ্যে শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব ও মাউশির ডিজির সঙ্গে এসব দাবি পূরণে স্মারকলিপি দিয়েছে এবং সাক্ষাৎও করেছে। তবে দাবিদাওয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ এখনও কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি।

সমাধান কোন পথে

শিক্ষকদের অব্যাহতি কিংবা পদত্যাগের বিষয়টি কীভাবে সমাধা করা যায়Ñ সে বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেনি সরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব শিক্ষক নিয়ে সরকার জটিল সমস্যায় পড়েছে। কারণ ভুক্তভোগী শিক্ষকদের অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তাদের অবস্থান ছিল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। তাই মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দিলেও তা স্থানীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তাই আমরা এই শিক্ষকদের স্থানীয়ভাবে ইস্যুটি মিটিয়ে ফেলে বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘যদি কেউ যোগদান করতে না পারেন, তাহলে সর্বজনীন বদলির মাধ্যমে ভুক্তভোগী শিক্ষককে অন্য কোথাও বদলি করে বিষয়টি সমাধানের চিন্তা করা হচ্ছে। শিগগিরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

 

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

‘পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষক জোটের’ আহ্বায়ক আনোয়ারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকদের অপমান-অপদস্থ, হেনস্থা ও মারধর করে জোর করে পদত্যাগ, অপসারণ, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক ছুটি, কর্মস্থলে বাধাগ্রস্ত ও প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বল্প বেতনে নিয়োজিত শিক্ষকেরা ব্যক্তি আক্রোশের শিকার হয়ে অন্যায় ও মব জাস্টিসের মতো বর্বরতার কবলে পড়েছেন । কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কেউ চাকরি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ-বা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়েই বিভিন্নভাবে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কখনও শিক্ষকদের ওপর এভাবে মব জাস্টিস করে পদত্যাগ করানো হয়নি। বিষয়টির সমাধানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সরকার একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে এসব শিক্ষককে পুনর্বহাল করতে পারে।’

মাউশির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক এবিএম রেজাউল করীম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া জন্য চিঠি দিয়েছি।’

শিক্ষা উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা) অধ্যাপক ড. এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি সমাধানে কাজ করা হচ্ছে। শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।’

Sharing is caring!