প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২রা রজব, ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থের জোগানই বড় সমস্যা

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪, ১২:০৮ অপরাহ্ণ
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থের জোগানই বড় সমস্যা

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে চলে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ না থাকায় বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে; বিশেষ করে ডলার-সংকটের এই সময়ে, যখন বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি সবচেয়ে জরুরি, তখন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই আগ্রহহীন হয়ে পড়েছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৯১ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও একটি বড় সমস্যা—একদিকে আগের প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থছাড়ও কমে গেছে ২৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, অন্যদিকে আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধের হার বেড়েছে ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে; কারণ, বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের চাপ ক্রমশ বাড়ছে, যা দেশের আর্থিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং মূল্য সংযোজনের সুযোগ সীমিত করছে। সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান নিশ্চিত করা এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতিকে বিপর্যস্ত করতে পারে।

 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে বৈদেশিক ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। ইআরডি গতকাল রোববার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের বৈদেশিক অর্থায়ন-সম্পর্কিত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৫২ কোটি ২৬ লাখ ডলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫৮৫ কোটি ৯১ লাখ ডলার। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ৯০ শতাংশের বেশি কমেছে। এ বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, বাংলাদেশকে বৈদেশিক ঋণ হিসেবে ১৫৪ কোটি ৩৭ লাখ ডলার ছাড় করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা, তবে একই সময়ে ঋণ পরিশোধে উন্নয়ন সহযোগীদের পেছনে খরচ হয়েছে ১৭১ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ২০ হাজার ৪২৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১০৫ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার গেছে মূল ঋণ পরিশোধে, আর ৬৫ কোটি ৫১ লাখ ডলার গেছে ঋণের সুদ পরিশোধে।

এ ছাড়া চলতি বছরের পাঁচ মাসে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১৭১ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ১৩৩ কোটি ২১ লাখ ডলার। অর্থাৎ, ২০২৪ সালে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বেশি ঋণ নেওয়ার ফলে বর্তমান সরকারের ওপর ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের অধীনে প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ফলে অর্থছাড় এবং নতুন প্রকল্পের অনুমোদন কমে গেছে, ফলে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতিও কমেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আইএনএমের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী জানান, প্রকল্প প্রস্তুতি ও কাজের অগ্রগতি না হওয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এবং অর্থছাড় কমেছে। তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরা কাজের অগ্রগতি অনুযায়ী অর্থছাড় করে, তবে গত দুই মাসের আন্দোলনের কারণে কাজ হয়নি, তাই অর্থছাড়ও কমেছে। তবে কাজের অগ্রগতি বাড়লে অর্থছাড়ও বৃদ্ধি পাবে, যা সাময়িক একটি অবস্থা।

সূত্র মতে, ২০২৩ সালে বৈদেশিক ঋণ ছাড় ছিল ২১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং ঋণ পরিশোধ ছিল ১৩৩ কোটি ২১ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৩৩ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, যার মধ্যে ২৯ কোটি ডলার আসল পরিশোধ বেড়েছে। তবে চলতি বছরে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমে গেছে। ৫ মাসে প্রতিশ্রুতি এসেছে ৫২ কোটি ২৬ লাখ ডলার, যেখানে গত বছর একই সময়ে ছিল ৫৮৫ কোটি ডলার।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ চুক্তি হয়েছিল। ফলে প্রতিশ্রুতি বেড়েছিল। তবে নতুন সরকার আসার পর প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হচ্ছে। এতে ঋণচুক্তি কমেছে। তাঁরা আশা করছেন, শিগগির ঋণচুক্তি বাড়বে। তাঁরা বলেন, অন্তর্বতী সরকার গঠনের পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বহুপক্ষীয় এবং বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ ও বাজেট সহায়তার প্রাথমিক আশ্বাস দিয়েছে। ডিসেম্বরেও বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ঋণচুক্তি হয়েছে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা; তবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য এসেছে। তিনি বলেন, অহেতুক প্রকল্প বাতিলের মাধ্যমে উন্নয়ন বাজেট ছোট হলেও প্রবৃদ্ধি কমবে না। এ ছাড়া তিনি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করে প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং বাজেট ঘাটতি সহনীয় রাখতে এডিপি সংশোধনের কাজ চলছে।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৩৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে, যা আগের বছর থেকে ৬৮ কোটি ডলার বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ হয়েছিল। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে, এবং গত বছর সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪১ কোটি ডলার। চলতি বছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে।

তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে পদ্মা রেলসংযোগ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আলাদা চাপ তৈরি হয়েছে। অথচ মেট্রোরেল বাদে পদ্মা রেলসংযোগ ও কর্ণফুলী টানেল থেকে তেমন রিটার্ন আসছে না; যা আয় হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মেইনটেইন্যান্সে খরচ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে নিজের তহবিল থেকে এসব প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

Sharing is caring!