প্রজন্ম ডেস্ক:
আগামীর বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে কেন্দ্র করে রাজনীতি চান না জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি এমন বাংলাদেশ চান, যেখানে শুধু দুটি রাজনৈতিক দলের বন্দোবস্ত হবে না। তার এই অভিমতের সঙ্গে একমত পোষণ করে তরুণদের একটি অংশ। এ নিয়ে অবশ্য ভিন্নমতও পোষণ করা হয় সংশ্লিষ্ট দলগুলোর পক্ষ থেকেও।
শুধু এই বিষয়ই নয়, ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে (কেআইবি) সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংলাপে ইতিবাচক নানা প্রত্যাশার সঙ্গে উঠে আসে সম্ভাব্য বাধার কথাও। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এই জাতীয় সংলাপে পাঁচটি সেশনে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের অভিমত দেন। পাশাপাশি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন জুলাই আন্দোলনে আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যরা।
বিশিষ্ট সমাজচিন্তক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘আমাদের জাতিটা নানান দিক থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে গেছে, শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে গেছে। সবার মধ্যে শৃঙ্খলাবোধও কমে গেছে। এখানে ভালো ভালো কথা পত্র-পত্রিকায় ও টকশোতে থাকে। শৃঙ্খলা আনতে হলে বাস্তব অবস্থাটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝতে হয়।
তিনি বলেন, দেশে ১৮ কোটি মানুষ, সাড়ে ১২ কোটি ভোটার কী অবস্থায় আছে তা দেখতে হবে। তাদের ধর্মবিশ্বাস, চিন্তাচেতনা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, আদর্শবোধ তথা এককথায় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি পক্ষপাতমুক্ত দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে হবে। এই অবস্থার মধ্যে সম্ভাবনার দিক কী কী তা ঠিক করা উচিত। ঐকমত্য ও বিরোধিতার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা উচিত। সে অনুযায়ী কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সবার বাকস্বাধীনতা আছে। বিভিন্ন বিষয়ে সবাই সবার মতামত দিচ্ছে। এখান থেকে কে কোনটা গ্রহণ করবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
তিনি বলেন, বিভক্তি ছাড়া কোনো দেশ নেই। জাতীয় ঐকমত্য ঠিক আছে। জাতীয় ঐকমত্য থাকলে কোনো দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকত না। ওই রকম ঐকমত্য আছে ভিয়েতনাম, চীন ও রাশিয়ায়। ওই সব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আর কোনো পার্টি নেই। সবাই কত ব্যাপারে একমত। যেখানে রাজনৈতিক দল আছে, সেখানে দ্বিমত থাকবে।
সংলাপের প্রথম অধিবেশনে ‘ঐক্য কোন পথে’ শীর্ষক আলোচনায় দীর্ঘমেয়াদে ঐক্যের বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শুধু সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে ঐকমত্য তৈরি হলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে আবারও সংকট তৈরি হতে পারে। এ জন্য সবার চরিত্রগত পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গন, বাজার সিন্ডিকেট, আইন-আদালত, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না আসায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
সম্প্রতি রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার ফুটওভার ব্রিজসংলগ্ন যাত্রীছাউনি ব্যবহার করা নিয়েও একই ধরনের হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। যাত্রীদের বসার জন্য যাত্রীছাউনি হলেও সেখানে জিনিসপত্র রেখে ব্যবসা করছেন হকাররা। ফলে অসুস্থ বা বয়স্ক মানুষরা ওভারব্রিজ পার হয়ে বিশ্রাম নিতে চাইলেও পারেন না। সেখানে বসতে চাইলে হকাররা বাধা দেন। সহযোগিতা চেয়ে খিলক্ষেত এলাকার একটি ফেসবুক গ্রুপে পোস্টে একজন লেখেন, ‘যতই রক্ত দিই না কেন, এই দেশটা ঠিক হবে না। মানুষের চরিত্রগত পরিবর্তন আনতে হবে।’ আরেকজন লেখেন, ‘ছাত্ররা যখন ট্রাফিক কন্ট্রোল করেছিল তখন সব ঠিক ছিল। এখন আবার এলোমেলো।’
তবে এই পরিবর্তন না হওয়া নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবাইকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারছি না। যার জন্য দেশের পরিবর্তন আসছে না।’
জাতীয় সংলাপেও ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানেও গণতন্ত্রের অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্য তৈরি না হওয়ার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে সংলাপে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখার ঘটনা উদ্ধৃত করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ, সংস্কারের ক্ষেত্রেও ঐক্য লাগবে এবং ভালো ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ করে রাখারও প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ‘রক্তের ঋণ ও ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা’ শিরোনামে। এই পর্বে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ করা, বিদেশনীতি একই রাখা, সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং স্থিতিশীল বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে এসবের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাব, বিভিন্ন দেশের বলয়, সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবে অনমনীয়তাকে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তৃতীয় অধিবেশনে ‘গুম-খুন থেকে জুলাই গণহত্যা: বিচারের চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আগামী এক বছরের মধ্যে জুলাই গণহত্যার বিচারের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এই আলোচনায় অভিযুক্তদের বিচারে ঐক্য ও সংস্কারের বিষয়টিও সমান্তরালভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে ঐক্য ও সংস্কার যথাযথভাবে না হলে এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
চতুর্থ অধিবেশনে ‘সংস্কারের দায় ও নির্বাচনের রূপরেখা’ শীর্ষক আলোচনায় ঐকমত্য, তরুণদের দল গঠন, রাজনৈতিক দলগুলোর আয়, শিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অবস্থানও উঠে আসে। এসব বাস্তবায়নে বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে সংস্কারের জন্য ঐকমত্য অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করেন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘মূল কথা হলো, ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হবে। আমরা নির্বাচন চাই। এই নির্বাচনের জন্য সংস্কার দরকার। যাতে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ হয়। এ জন্য আবার ঐকমত্যটা দরকার। এ ক্ষেত্রেও ভিন্নমত থাকবে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলোর পক্ষে ঐকমত্য তৈরি করাই এই মুহূর্তে করণীয়। আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য আছেই। তবে অধিকাংশের একমত, কতগুলো সংস্কার হওয়া দরকার। এ জন্য ঐক্য দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার এবং এই সংস্কারের জন্য ঐকমত্য দরকার।’
পঞ্চম অধিবেশনে ‘ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক আলোচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় নিরাপত্তা নীতি তৈরি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। তবে এতেও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে বাংলাদেশে। দেশের এক দল ভারতবিদ্বেষী, যুক্তরাষ্ট্রপন্থি। আরেক দল ভারতমুখী, যুক্তরাষ্ট্র বিদ্বেষী। এ নিয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, দুই পন্থিদের বিভক্তি দূর করতে হবে। একই সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ তিনটি বিষয়েই কাঙ্ক্ষিত সফলতার জন্য রাজনৈতিক মানসিকতা এবং সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। অন্যথায় প্রত্যাশা পূরণে নানা বাধা তৈরি হবে।
Sharing is caring!