প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

অজ্ঞাত মৃতদেহে উদ্বেগ

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ১২:০১ অপরাহ্ণ
অজ্ঞাত মৃতদেহে উদ্বেগ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায়ই ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ মরদেহ উদ্ধারের প্রতিবেদন প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে। তাদের কেউবা হত্যার শিকার আবার কেউবা দুর্ঘটনায় বা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে। কিন্তু এর মধ্যে কিছু মৃত্যু রয়েছে, যার কারণ তো বটেই, মৃত ব্যক্তির পরিচয়ও জানতে পারা যায় না। তারা আইনের অভিধান অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নথিতে শুধুই স্থান পান ‘অজ্ঞাতনামা’ বা ‘বেওয়ারিশ’ অভিধায়। পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নর্দমা, রাস্তা বা রেলপথ থেকে উদ্ধার হওয়া এসব মরদেহ বুঝে নেওয়ার মতো স্বজন বা পরিচিত কেউ থাকেন না। যে কারণে শেষমেশ ‘বেওয়ারিশ লাশ’ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বা অন্য কোনো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দাফন হয় মরদেহগুলো। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে এমন ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েছে, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানবাধিকারকর্মীরা।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৩৭৭টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। যেখানে গত বছরের একই সময়কালে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল ২৯৫টি। এই দুই বছরের তুলনামূলক হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরে এখন পর্যন্ত অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েছে ২৮ শতাংশ।

দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বেড়ে গেলে সাধারণত এ ধরনের মরদেহ বেশি উদ্ধার হয় বলে মনে করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সাঈদুর রহমান। দীর্ঘদিন ধরে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনি ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘সবসময় অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহগুলোর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। গত তিন মাসে সেটা উদ্বেগজনক হারে বেশি।’ এই হার বৃদ্ধির পেছনে নানা কারণ

থাকতে পারে উল্লেখ করে সাঈদুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু জুলাই-আগস্টে সারা দেশে একটা বড় অভ্যুত্থান হয়েছে এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্বাভাবিক অবস্থা ছিল। সেই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। এতে কত মানুষ মারা গেছে, সেটার সংখ্যাও তো আমরা জানি না। এ ছাড়া আন্দোলনে অংশ নিতে ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক মানুষ এসেছিল। তারা নানাভাবে মারা পড়েছে, যাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এতসংখ্যক অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ মরদেহ উদ্ধারের পেছনে এটা একটা কারণ হতেই পারে।’

 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের লাশঘরে হিমায়িত অবস্থায় এখনো পড়ে আছে বেশ কিছু মরদেহ, যেগুলোর পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এর মধ্যে সাতটি মরদেহের শরীরে গুলিসহ অন্যান্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। জুলাই-আগস্টের উত্তাল সময়ে রাজধানীসহ দেশের নানাপ্রান্ত থেকে গুলিবিদ্ধ শত শত মরদেহ এসেছিল ঢামেক হাসপাতালে। সেসবের প্রায় সবই নিহতের স্বজনরা শনাক্তের পর নিয়ে গিয়ে দাফন করেছে। তখনকার মরদেহগুলোর মধ্যে থেকে এ সাতটি মরদেহ এখনো রয়েছে লাশঘরে। প্রাণহীন এ দেহগুলোর আইনি ভাষায় এখন একমাত্র পরিচয় ‘অজ্ঞাতনামা’ বা ‘বেওয়ারিশ’ লাশ। তারা গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন বলে ধারণা করা হলেও মরদেহ নিতে আসেননি কোনো স্বজন। যদিওবা কয়েকজন এসেছিলেন কিন্তু তারা নিজেদের স্বজন হিসেবে শনাক্ত করতে পারেননি।

 

এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতাল মর্গের ইনচার্জ রামু চন্দ্র দাস বলেন, ‘এখন মর্গে এরকম সাতটি মরদেহ আছে। প্রথমে ছিল আটটি। সবই জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময়কার। তাদের মধ্যে থেকে একজনের মরদেহ শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন স্বজনরা। বাকি সাতজনকে কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। অনেকেই আসছেন, দেখছেন তারপর চলে যাচ্ছেন। বাকি সাতটি মরদেহের ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এখনো কারও পরিচয় শনাক্ত হয়নি।’

 

অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি : এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ৩৫টি। তার মধ্যে ৭ নারী, ২৮ জন পুরুষ। আগস্টে উদ্ধার হয়েছে ২৯ জনের মরদেহ। তাদের মধ্যে একজন কিশোর, একজন নারী, ১৯ জন পুরুষ ও আটজন যুবক। সেপ্টেম্বরে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ৪৮টি। এর মধ্যে পাঁচজন কিশোর-কিশোরী, ১৪ জন নারী ও ২৯ জন পুরুষ। সব মিলিয়ে এই তিন মাসে উদ্ধার হয় ১১২টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ। এসব মরদেহের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ৭৬ জন। অন্যদিকে ২০২৩ সালের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ৯৯টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল। তার মধ্যে জুলাইয়ে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার হয় ৩৪টি। এর মধ্যে একজন কিশোর, ১০ জন নারী, ২০ জন যুবক ও তিনজন বৃদ্ধ। আগস্টে ২৪টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একজন শিশু, একজন কিশোর, তিনজন নারী, ১৩ জন যুবক, তিনজন মাঝবয়সীসহ আরও তিনজন। পরের মাসে উদ্ধার হয়েছে ৪১টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ। যাদের মধ্যে তিনজন কিশোর-কিশোরী, তিনজন তরুণী, পাঁচজন নারী ও ২৯ জন পুরুষ। এই তিন মাসে অজ্ঞাতপরিচয় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল ২৯ জনের। দুই বছরের তুলনামূলক হিসাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধারের হার আড়াই ভাগ বেশি।

 

৩৫ দিনে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ৬৯ অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ দাফন : জুলাই ও আগস্ট মাসে গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ দাফন হয়েছে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হিসাব অনুযায়ী, তাদের তত্ত্বাবধানে গত জুলাইয়ের ২২ থেকে আগস্টের ২৬ তারিখ পর্যন্ত ৬৯টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ দাফন করা হয়েছে সেখানে। বুদ্ধিজীবী কবরস্থান সরেজমিনে ঘুরে সংস্থাটির দেওয়া তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টে জুরাইন কবরস্থানে অন্তত ১০টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ দাফন করা হয়। কবরস্থানটি পরিচালনা-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দায়িত্বশীলরা বলেছেন, রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের মরদেহগুলোর মধ্যে ২২ জুলাই ১১টি, ২৩ জুলাই একটি, ২৪ জুলাই ৯টি, ৫ জুলাই তিনটি, ২৭ জুলাই সাতটি, ২৮ জুলাই ১১টি, ২৯ জুলাই একটি এবং ৩১ জুলাই দাফন করা হয় তিনটি। এ ছাড়া আগস্ট মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত তারা দাফন করেছে ২৩টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ। এসব মরদেহ ঢামেক হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ (মিটফোর্ড) মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের একাধিক গোরখোদক ও দায়িত্বশীলরা বলেছেন, জুলাই মাসে ৮১টি ও আগস্টে ৩৩টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ দাফন করা হয় সেখানে।

 

গত বছরের তুলনায় চলতি বছর অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধারের সংখ্যা বাড়ার বিষয়টি কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। সেই সঙ্গে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি ধীরে ধীরে উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিপন্থী সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সাঈদুর রহমান। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজ করার থাকলেও সংশ্লিষ্ট সবাই দায় এড়িয়ে যেতে চায় যায় বলে অভিযোগ এই মানবাধিকারকর্মীর। তিনি বলেন, ‘অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহগুলো উদ্ধারের পর থানায় মামলা হবে। সেই মামলার তদন্ত হবে, চার্জশিট হবে। তাহলে মৃত্যুর কারণসহ ভুক্তভোগীর যাবতীয় পরিচয় বেরিয়ে আসবে। পুলিশের কাছে গেলে মামলা নিতে চায় না। তারা হাসপাতালের মাধ্যমে নানাভাবে মরদেহগুলো দাফনের চেষ্টা করে।’

 

২৪ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত : গত বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিল এমএসএফ। সার্বিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টিকে আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল বেসরকারি এই সংস্থা। সে সময় তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে উদ্ধারের পর মরদেহগুলোর মধ্যে ২৪ শতাংশ শনাক্ত করা সম্ভব হলেও বাকিদের পরিচয় অজানা থেকে যায়। তবে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ শনাক্তের ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি তৎপর ও সক্রিয় থাকার দাবি করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে প্রাযুক্তিক সুবিধা ব্যবহার থেকে শুরু করে নানা আইনি প্রক্রিয়া খুবই সতর্কভাবে মানা হয় বলে দাবি করেন পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর। তিনি বলেন, ‘অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ শনাক্তে বিশেষ কিছু আইনি প্রক্রিয়া মানতে হয়। বাংলাদেশ পুলিশ সেগুলো খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই করে থাকে। এখন সিআইডির মাধ্যমে ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করে খুব সহজেই একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা হয়ে থাকে। পরিচয় শনাক্তে সময় লাগে যেসব মরদেহ পচে-গলে যায় সেগুলোর ক্ষেত্রে। কারণ তাদের শরীর থেকে ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়। সেগুলো আবার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করা হয়। তাই একটু সময় লাগে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা পরিচয় শনাক্ত করি।’

Sharing is caring!