প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

খাদ্যে মেশাতে হবে না রাসায়নিক

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ
খাদ্যে মেশাতে হবে না রাসায়নিক

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

পরমাণুশক্তির সাহায্যে খাবার সংরক্ষণে ই-রেডিয়েশন সেন্টার (গামা সেন্টার) তৈরির কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ পরমাণুু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। ফলে খাবার সংরক্ষণে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানোর প্রয়োজন পড়বে না। গুণ, মান ও ওজন ঠিক রেখে আধুনিক এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতি কেজি খাবার সংরক্ষণে খরচ হবে ১ থেকে ৭ টাকা। চিকিৎসা সরঞ্জামাদিও জীবাণুমুক্ত করার সুযোগ মিলবে এ সেন্টারে।

একই ধরনের আরেকটি কেন্দ্র রয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীন ইনস্টিটিউট অব রেডিয়েশন অ্যান্ড পলিমার টেকনোলজিতে। সেখানে গবেষণার পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণে খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার কাজ করা হয়। এটিরও সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবাণুমুক্ত করার মাধ্যমে পণ্যের ‘শেলফ লাইফ’ বাড়ানোর এ পদ্ধতি দেশে রাসায়নিক ও ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাবার সরবরাহ ও রপ্তানির সুযোগ আরও বাড়াবে। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্যের পচন রোধ করাও সম্ভব হবে। এ প্রক্রিয়ায় ৯৯.৯৯ শতাংশ রোগ সংক্রমণকারী ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের পাশাপাশি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের অপচয় কমে। এ ধরনের কেন্দ্রের সংখ্যা আরও বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।

পরমাণু শক্তি কমিশনের গামা সেন্টার : ঢাকার সাভারে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ইনস্টিটিউট অব রেডিয়েশন অ্যান্ড পলিমার টেকনোলজির যাত্রা শুরু। সেন্টারটিতে (কোবাল্ড-৬০ প্ল্যান্ট) গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পণ্য সংরক্ষণের কাজ করা হয়। এ কেন্দ্রে গামা উৎস দিয়ে মসলাজাতীয় দ্রব্য, পশুখাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী জীবাণুমুক্ত করা হয়। এখান থেকে ই-রেডিয়েটেড পণ্য রপ্তানিও করা হয়।

শুরুতে কেন্দ্রটির সক্ষমতা ছিল ৩৫০ কিলো কিউরি। এখন এর সক্ষমতা কমে ৪২ কিলো কিউরিতে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে আরও ৪০০ কিলো কিউরি ক্ষমতা যুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ড. রুহুল আমিন খান বলেন, ‘রাশিয়া থেকে রেডিয়েশন সোর্স (কোবাল্ড-৬০) চলে এসেছে। কেন্দ্রের মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ কেন্দ্রটির পুরো কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।’

তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রটির মাধ্যমে বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ টন মসলাজাতীয় খাবার, ২০০ টন পশুখাদ্য ও ১০০ টন আম সংরক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া ৩ থেকে ৫ হাজার বর্গফুট চিকিৎসা সরঞ্জামাদি জীবাণুমুক্ত করা যাবে। প্রতি কেজি আলু ও পেঁয়াজে ১, আমে ৭, মসলায় ৩৪ টাকা চার্জ দিয়ে উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য জীবাণুমুক্ত করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। এসব পণ্য রপ্তানির সুযোগও রয়েছে।’

রুহুল আমিন বলেন, ‘করোনা মহামারীর পর আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ খাবার আমদানিতে একটা নিয়ম চালু করেছে বায়োডাইভার্সিটি রুল। খাবারটি রোগ জীবাণুমুক্ত মর্মে তাদের সনদ দিতে হবে। বাংলাদেশকেও খাবার রপ্তানিতে এ নিয়ম মানতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। তারা দুবেলা মসলাযুক্ত খাবার খান। প্রচুর পরিমাণ মসলার চাহিদা রয়েছে। মসলা রপ্তানিতে বিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউরোপ- আমেরিকায় জীবাণুমুক্ত পশুখাদ্যের চাহিদা বাড়ছে।’

৫২ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রটির সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রসাতমের সায়েন্টিফিক ডিভিশনের অধীন প্রতিষ্ঠান। রসাতমের কর্মকর্তারা ইমেইলে দেশ রূপান্তরকে জানান, প্রকল্পটির যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শেষ হলে এখানে প্রতি ঘণ্টায় ১ থেকে ১.২ টন পণ্য প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শোষণকৃত ডোজের পরিমাণ হবে ১০ কিলো-গ্রে। ক্ষতিকর রাসায়নিক ছাড়াই কৃষিজাত ও মেডিকেল পণ্য সংরক্ষণের সময় ২ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়বে।’

সাভারের গামা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে রসাতমের সঙ্গে কাজ করছে দেশি প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট করপোরেশন। এর প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আলম বাহাদুর বলেন, ‘কেমিক্যাল ব্যবহার করে পণ্য সংরক্ষণ ব্যয়বহুল ও ক্ষতিকর। ই-রেডিয়েশন সেন্টার এর ভালো ও স্থায়ী সমাধান দেবে। আমেরিকা, ইউরোপে জীবাণুমক্ত পণ্যের চাহিদা ব্যাপক। জীবাণুমুক্ত করতে পারছি না বলে আমরা বিশ্ববাজারে ঢুকতে পারছি না। সরকার ই-রেডিয়েশন সেন্টারে যথেষ্ট অর্থায়ন করলে ও বেসরকারি খাতগুলো এগিয়ে এলে যৌথ উদ্যোগে ই-রেডিয়েশন সেন্টারে খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যের শেলফ লাইফ বাড়িয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।’

বিনার গামা সেন্টার : বিশ্বব্যাংকের পার্টনার প্রকল্পের আওতায় ১১৫ কোটি টাকায় গাজীপুরের ভবানীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গামা সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিনা আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিআইআরসি সেন্টারটি স্থাপন করবে। এটির কাজ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আশা।

বিনার পরিচালক (পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ) ড. শরিফুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘আলু, পেঁয়াজ, সবজি, আম, মসলাসহ সাত ধরনের কৃষিপণ্য ই-রেডিয়েটেড করার জন্য কেন্দ্রটি করা হচ্ছে। এখানে সব ধরনের পণ্যই জীবাণুমুক্ত করা যাবে। এ কেন্দ্রে প্রতি ঘণ্টায় ১০ টন আলু, পেঁয়াজ প্রভৃতি পণ্য জীবাণুমুক্ত করা যাবে। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে রেডিয়েশেনের মাত্রাভেদে পরিমাণে কমবেশি হবে। এখান থেকে সার্ভিস চার্জ বাবদ বছরে ২৭ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পণ্যের পচনরোধের মাধ্যমে আরও ৫৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আলু ও পেঁয়াজ ৬ থেকে ৮ মাস, আম ১২-১৫ দিন, সবজি ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। মসলা সংরক্ষণ করা যাবে এক বছরেরও বেশি সময়।’

পণ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া : প্রতিটি পণ্যের মধ্যেই সহনশীল মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া থাকে। উপযুক্ত পরিবেশে এর সংখ্যা বাড়ে। এ সংখ্যা বেশি হলে পণ্যে পচন ধরে। খাদ্যদ্রব্য বেশি দিন সংরক্ষণের জন্য প্রচুর পরিমাণে মানদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, যা উদ্বেগের কারণ। রাসায়নিক ছাড়া খাবার সংরক্ষণের আরেকটি উপায় হলো স্টিম বা বাষ্প; অর্থাৎ তাপ দিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলা। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত তাপে খাবারের গুণ নষ্ট হয়। কেমিক্যাল ও স্টিম ছাড়া তৃতীয় উপায় হলো ই-রেডিয়েশন, যাতে কোবাল্ট-৬০ ব্যবহৃত হয়। কোবাল্ট-৬০ থেকে গামা রশ্মি যখন পচনশীল পণ্যের ওপর ফেলা হয়, তখন এর মধ্যকার ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর ক্ষুদ্র উপাদান মরে যায়। ই-রেডিয়েটেড পণ্যের ‘শেলফ লাইফ’ বেড়ে যায়। ঘণ্টায় কয়েকশ বাক্স ই-রেডিয়েটেড করা সম্ভব। অবশ্য পণ্যভেদে রেডিয়েশনের মাত্রাভেদ হয়।

মানবদেহের জন্য রেডিয়েশন কতটা ক্ষতিকর : পণ্যভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিয়েশন প্রয়োগ করে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা হয়, যা মানবদেহের ক্ষতি করে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রেডিয়েশন মানেই ক্ষতিকর কিছু নয়।

রেডিয়েটেড খাদ্যকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও গামা রেডিয়েশনকে কার্যকরী প্রক্রিয়া বলে অনুমোদন দিয়েছে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, কৃষি সংস্থা (এফএও) ও ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইএসডিএ) বিকিরণযুক্ত খাবারের নিরাপত্তাকে সমর্থন করেছে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রুহুল আমিন খান বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের রেডিয়েশন রয়েছে। হাসপাতালে এক্স-রে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহারের ফলে মানবদেহের ক্ষতি হয় না। আবার মোবাইলসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে নানা ধরনের রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয়। বৈদ্যুতিক বাতি থেকেও রেডিয়েশন ছড়ায়। এগুলো মানবদেহের জন্য সহনশীল। একইভাবে রেডিয়েশনের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের সংরক্ষণ মানদেহের ক্ষতি করে না।’

একটা নির্দিষ্ট এলাকায় কোবাল্ড-৬০ থাকবে যেখান থেকে রেডিয়েশেন ছড়িয়ে মানুষের ক্ষতি করবে না। কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে যাওয়ার সময় পণ্যের ওপর সহনশীল মাত্রায় রেডিয়েশন প্রযুক্ত হবে। মানবদেহের ক্ষতি এড়াতে রেডিয়েশনের উৎসটি ১৬ ফুট নিউক্লিয়ার গ্রেড ওয়াটারে নিমজ্জিত অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়।

পণ্যের পচন রোধ : বিনার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৩২ থেকে ৩৪ লাখ টন। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ পচে যায়, ফলে প্রকৃত উৎপাদন হয় ২২-২৩ লাখ টন। ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে দেশে। প্রতি বছর প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজ আমদানিতে বিপুল অর্থ খরচ হয়। এ পেঁয়াজ সংরক্ষণে প্রতি মাসে অনেক বিদ্যুৎ বিল গুনতে হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো সংরক্ষণও করা যায় না।

সঠিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ হয় না বলে লোকসান গুনতে হয় কৃষকদের। নষ্ট হওয়ার ভয়ে কৃষক আগেভাগেই কম দামে পেঁয়াজ বেচতে বাধ্য হয়। মধ্যস্বত্বভোগীরা সে পেঁয়াজ বাড়তি দামে বেচে ক্রেতার কাছে। বছরের বেশিরভাগ সময়ই বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে নৈরাজ্য চলে।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) সাবেক মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ‘বছরে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। দেশে রেডিয়েশন প্রয়োগের ২৫-৩০টি প্ল্যান্ট স্থাপন করা গেলে বিপুল পরিমাণ ফসলের অপচয় রোধ করা যাবে।’

Sharing is caring!