প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

জলবায়ু অর্থায়নের টাকা কীভাবে পাবে বাংলাদেশ?

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১২, ২০২৪, ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ
জলবায়ু অর্থায়নের টাকা কীভাবে পাবে বাংলাদেশ?

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে গত ১১ থেকে ২২ নভেম্বর হয়ে গেলো জলবায়ু সম্মেলন-২৪ (কপ২৯)। জাতিসংঘের এবারের জলবায়ু সম্মেলনে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দরিদ্র দেশগুলোকে বছরে অন্তত ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ধনী দেশগুলো। সম্মেলনে অতিরিক্ত ৩৩ ঘণ্টা লেগেছে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে।

এই চুক্তি কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। আবার বাংলাদেশের মতো দেশগুলো কীভাবে অর্থ পাবে তাতেও রয়েছে একধরনের জটিলতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে ভেস্তে যাবে এই সম্মেলনের উদ্দেশ্যও।

 

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবারের গঠিত তহবিল নিয়ে সমালোচনা করেন। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো তহবিল থেকে ন্যায্য পাওনা কতটা পাবে, তা নিয়ে সন্দিহান তারা। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নতুন ও অতিরিক্ত তহবিল, ঋণের বদলে অনুদান এবং সুস্পষ্ট তহবিলের দাবি করলেও সেগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে এবারের সম্মেলনে। এবারের কপকে ‘ক্লাইমেট ফাইন্যান্স কপ’ নামে অভিহিত করা হলেও উন্নত দেশগুলো ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল নিয়ে একমত হতে পারেননি।

আজারবাইজানে জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের বিরোধিতা করেন সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে প্রতিবাদ মিছিলেও অংশ নেন। ২১ বছর বয়সী গ্রেটা থুনবার্গ এবং মিছিলে অংশ নেওয়া অন্য পরিবেশকর্মীরা বলেন, নিপীড়নমূলক নীতির কারণে জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজক হওয়ার যোগ্য নয় দেশটি। তার কারণ হলো বিশ্বের অন্যতম জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশ আজারবাইজান।

থুনবার্গের অভিযোগ, আজারবাইজান একটি নিপীড়ক ও দখলদার রাষ্ট্র। দেশটি জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে। নাগরিক সমাজের ওপর ক্রমাগত দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। থুনবার্গ এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, জলবায়ু সংকটের কারণে বিপুল সংখ্যক জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে বা হবে, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের কারণে অগণিত মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে চলেছে। জলবায়ু সংকটে যেমন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, তখনও সারা বিশ্বে নিপীড়ন, অসমতা, যুদ্ধ এবং গণহত্যা তীব্রতর হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা আমাদের জীবন সহায়ক ইকোসিস্টেম আরও অস্থিতিশীলতা ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউজ গ্যাস গত বছরও সর্বকালের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সিস্টেমগুলো আমাদের পক্ষে কাজ করছে না। কপের প্রক্রিয়াগুলো কেবল আমাদের ব্যর্থ করছে না, এর কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খেসারত দিতে হবে।

 

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কতটা সফল?

২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি চুক্তি হয়। জাতিসংঘের ১৯৬টি দেশ এতে সম্মতি দেয়। ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) গঠনের ২৩ বছর পর এই সম্মতিতে আসতে পেরেছিল জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো। এটি অনেকটা আশার সঞ্চার করেছিল বিশ্ববাসীর কাছে। প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হয়, বৈশ্বিক তাপমান দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা। সেজন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য লড়াই করতে উন্নত দেশগুলোর বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার বিষয়টিও নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এই চুক্তিতে। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।

 

সদ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনরায় জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার লড়াইয়ে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেবল অভিঘাতের প্রথম সারিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তার দিক থেকে নয়, কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির প্রশ্নেও তারা এগিয়ে ছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে তার প্রথম মেয়াদে প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম দফার ক্ষমতায়নের মতো ফের ভেস্তে যেতে পারে বাকুর প্রতিশ্রুতি।

 

বাকুতে ড. ইউনূসের তিন শূন্য ধারণা

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাকু জলবায়ু সম্মেলনে ‘থ্রি জিরো বা তিন শূন্য’ তত্ত্বকেই তুলে ধরেছেন এবার। সম্মেলনে নিজের ভাষণে এই তত্ত্বের উপস্থাপনা করে তিনি বলেন, এটাই এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। গড়ে তুলবে এক নতুন পৃথিবী, যা সবার জন্য বাসযোগ্য হবে।

 

কপ-২৯ এর ওয়ার্ল্ড লিডার্স ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের সবাইকে শুধু এমন এক জীবনশৈলী গ্রহণ করতে হবে, যা এই পৃথিবীকে সবার জন্য নিরাপদ করে তুলবে।

 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী ধরনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

 

পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। চরম উষ্ণতা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদ-নদীর বন্যা, খরা, নদীভাঙন আকস্মিক বন্যা, শহরাঞ্চলের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তীব্র তাপপ্রবাহ, তীব্র শীত, বজ্রপাত, ভূমিধস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও অম্লতা। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছর বাংলাদেশকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে।

 

সেন্টার ফর পার্টিসেপটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডির) প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘কপ-২৯ এ নির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য আলাদা বরাদ্দ নেই। যে ৩০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য বরাদ্দ হয়েছে সেটা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দেওয়া হবে। বাংলাদেশকে এখান থেকে প্রস্তাব জমা দিয়ে তহবিল নিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যেসব টাকা বরাদ্দ হয়, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এসব টাকা আনতে একটি বৃহৎ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। টাকা কারা ব্যয় করবে কীভাবে ব্যয় করবে? যথাযথ ব্যবহার হবে কি না, টাকার হিসাব রাখবে কে? এসব বিষয় নিশ্চিত করে প্রস্তাব দিতে পারলে তহবিল পাওয়া সম্ভব। বরাদ্দ করা অর্থের কিছু অংশ যায় সরাসরি সবুজ জলবায়ু তহবিলে (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড-জিএফসি)। এছাড়া কিছু অর্থ আসে বহুপাক্ষিকভাবে যেমন: বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মাধ্যমে। তবে এসব ব্যাংক আমাদের অনুদান না দিয়ে ঋণ দেয়। আমরা যদি জলবায়ু অভিযোজনের কথা বলি, সেটা হলো অনুদান আদায় করা, কোনোভাবেই ঋণ নয়। এসব জায়গা থেকে টাকা আনতে হলে আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি দরকার।’

 

শামসুদ্দোহা বলেন, ‘ভালো অর্থ পেতে হলে ভালো মানের প্রজেক্ট তৈরি করতে হবে। আমাদের একটা সমস্যা হলো, আমরা নিজেদের জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ও ক্ষয়ক্ষতি প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে যাই, কিন্তু ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থ কীভাবে কাজে লাগাবো, সেটা ইফেকটিভ হবে কি না? অর্থের যথাযথ ব্যবহার ও সঠিকভাবে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রস্তাব দিতে পারি না। এসব কারণে তহবিল থেকে বঞ্চিত হতে হয়।’

 

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপির) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বর্তমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দৈনিক এক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু তারা পাচ্ছে মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার আগের চেয়ে অর্থের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু এ তহবিল পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বেগ পোহাতে হবে বাংলাদেশকে। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা উপকার হতে পারে।

কপ সম্মেলনের শুরুতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রধান প্রচেষ্টা হবে উদ্বেগ ও দাবিগুলো কপ-২৯-এর চূড়ান্ত ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করা। জলবায়ু সমস্যার সমাধানে পানির সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব দেওয়া।’ নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরির আহ্বানও জানান ড. ইউনূস।

Sharing is caring!