প্রজন্ম ডেস্ক:
দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন— এমন আশা রাজনৈতিক দলগুলোর। এসব দলের নেতারা বলছেন, সংস্কার কার্যক্রমের জন্য যৌক্তিক সময় রেখে সরকারের উচিত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। রোডম্যাপ ঘোষণা না করার ফলে দেশে একটি গুমোট পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে।
তারা বলছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপ না থাকায় পুরোমাত্রায় নির্বাচনী কার্যক্রমে নামতে পারছে না দলগুলো। ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি পালন করে সময় পার করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশে-বিদেশে অবস্থান করে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ না থাকায় দলের পক্ষ থেকে তৃণমূলে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা মোতাবেক তৃণমূলে দলকে সুসংগঠিত করার উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে। জেলায় জেলায় সম্ভাব্য অনেক প্রার্থী থাকলেও তা চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। ফলে নিজ নিজ এলাকায় যে যার মতো রাজনৈতিক বলয় তৈরি করছেন। তৃণমূল পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ।
তাদের অভিযোগ, এখনও আগের কায়দায় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কিংস পার্টি তৈরির চেষ্টা দৃশ্যমান। এমনকি দলের শীর্ষ নেতাদের রাজনীতি থেকে মাইনাস করার চেষ্টাও নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে দলের মধ্যে।
এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের আমলে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেখানে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। মানুষের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। অথচ আমাদের সংবিধান অনুযায়ী জনগণ হলো রাষ্ট্রের মালিক। সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছে। এখন সময়ে হয়েছে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। জনগণের দল হিসেবে বিএনপিরও একই চাওয়া।
‘শুরুর দিকে একেক দল একেক ধরনের কথা বললেও এখন সবাই চায় দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হোক। বিএনপিও মনে করে, যত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এতে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। সময় মতো এটি করতে না পারলে জনগণের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে একটি ভুল বার্তা যেতে পারে। আর জনগণের মধ্যে ভুল বার্তা যাক, এটি কারোরই কাম্য নয়।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সব সংস্কার করা সম্ভব না। নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার দরকার; যেমন- বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন— এগুলোর সংস্কার করে সরকারের নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। তা হলে জনগণ বুঝতে পারবে যে, সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করছে।
‘অন্তর্বর্তী সরকার যদি নির্বাচনী রোডম্যাপ (পথনকশা) প্রকাশ না করে তা হলে রাজনৈতিক দলগুলো ও অংশীজনদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আন্তর্জাতিকভাবেও যারা বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার, তারাও একটি রোডম্যাপ চায়। তারা তাদের বিনিয়োগের জন্য নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব বলেন, সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে আমরা পুরোদমে নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রম শুরু করতে পারতাম। দলের পক্ষ থেকেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্দেশনা দেওয়া যেত। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এখন যে ইস্যু সামনে আসছে আমরা সেটি নিয়ে পড়ে আছি। দলের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে দলের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনের প্যারামিটার আপ-ডাউন করছে।
‘অথচ আমাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, আগামী বছরের শেষে নির্বাচন হলেও বিএনপি ৬০-৬৫ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসবে।’
ওই নেতা অভিযোগ করেন, ‘আগের মতো এখনও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কিংস পার্টি তৈরির চেষ্টা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে জেলার ডিসি-ইউএনওদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের পরামর্শ নিতে, তাদের সহযোগিতা করতে। সরকারে তো তাদের প্রতিনিধিত্ব আছে। এরপরও কেন এমন নির্দেশনা? ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপির সন্দেহ তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আমরা মনে করি, অতীতেও কিংস পার্টি সফল হতে পারেনি, এবারও পারবে না।’
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমরা আরও এক মাস দেখব। এ সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচনের দাবিতে আমাদের নানামুখী কর্মসূচি থাকবে। প্রয়োজন হলে একটা সময় প্রকাশ্যে নির্বাচনের দাবিতে রাস্তায় নামব।
‘নির্বাচনী কার্যক্রম না থাকায় শিল্প অঞ্চলকেন্দ্রিক ঝুট ব্যবসা নিয়ে দলের কিছু নেতাকর্মী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া অনেক এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু নেতাকর্মী সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। ফলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, দিনদিন কমছে জনসমর্থন। মূলত নির্বাচনী কর্মকাণ্ড না থাকায় এমনটি হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির বারবার তাগাদা দেওয়ারও অন্যতম কারণ এটি।’
বিএনপির বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী যে কর্মকাণ্ড তা আবার ফিরে আসুক, আমরা কেউ চাই না। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম আমরা শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছি। কিন্তু সংস্কারের কথা বলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকা উচিত হবে না। এ সরকার তো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি। একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে। এখন তারা যদি মনে করে দীর্ঘসময় ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকবে, সেটি কেউ মেনে নেবে না।
তাদের অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক সিদ্ধান্তে দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। ৫ আগস্টের পরে সারা বিশ্বে যখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা হচ্ছে, তখন সরকার সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করল। কী কারণে এবং কার স্বার্থে এটি করা হলো, তা কারও বোধগম্য নয়। এ ঘটনায় ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা নানা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। এখন সবকিছু বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ভারতের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে গণফোরামের সভাপতি পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু এটি রাজনৈতিক সরকার নয়, ফলে তাদের অনেক সিদ্ধান্ত সঠিক হচ্ছে না বলে আমার মনে হয়। সংকটময় এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে জনগণের সরকার অর্থাৎ রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন।’
তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকার সাময়িক কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারে। তাদের পক্ষে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ, জনগণের ম্যান্ডেট তো তাদের নেই। রাজনৈতিক দলগুলো সাময়িক সময়ের জন্য তাদের সমর্থন দিচ্ছে, সবসময় তো দেবে না। মাঠে নেমে তাদেরই কাজ করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলো করবে না। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতারাও সবসময় তাদের জন্য কাজ করতে পারবে না। সরকারের বিভিন্ন ইস্যুতে তাদেরও দ্বিমত থাকতে পারে। সুতরাং সংস্কারের নামে সরকারের কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না।’
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া শরিকরা বলছেন, এখন তো সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন নেই। বড় দল হিসেবে বিএনপি ইস্যুভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। কিছু সাংগঠনিক কার্যক্রমও করছে। কিন্তু ছোট দলগুলো তো অলস সময় পার করছে। অথচ সরকার নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করলে দলগুলো নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারত। এখন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে ভাসানী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘আমরা মনে করি, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে সরকারের উচিত নির্বাচন দেওয়া। এ ছাড়া নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতেও বেশ সময়ের প্রয়োজন। আমরা আশা করব, সরকার শিগগিরই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।’
‘এখনই আমরা নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামতে চাচ্ছি না। হয়তো অচিরেই মাঠে নামার প্রয়োজন হতে পারে। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি এবং ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমার কর্মসূচি ঘোষণা করব।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com