প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

ফুটপাথে হকারদের রাজত্ব

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১১, ২০২৪, ১১:০২ পূর্বাহ্ণ
ফুটপাথে হকারদের রাজত্ব

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

রাজধানীতে ফুটপাথ দখলের প্রতিযোগিতায় মেতেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। আগের মতো চাঁদাবাজি বা কারও কাছে জবাবদিহিতা না থাকায় যে যেভাবে খুশি বেদখল করে নিচ্ছে ফুটপাথ। বিশেষ করে শীতের এই মৌসুমে এ প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এসব এখন দেখার কেউ নেই বলে হকাররাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

 

তবে ফুটপাথে দোকান বসাতে হলে এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে দ্বারস্থ হতে হয় বলেও জানান ফুটপাথের ব্যবসায়ীরা। অবৈধভাবে ফুটপাথ দখল করায় সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে বাধ্য হয়ে সবাই মূল সড়ক ব্যবহার করছে। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা।

 

গতকাল রাজধানীর নিউমার্কেট, ফুলবাড়িয়া ও গুলিস্তান এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, আগের চেয়ে ফুটপাথ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। তাদের অধিকাংশ হলো মৌসুমি ব্যবসায়ী। যারা শুধু শীতে বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা করছে। তাই আগের চেয়ে অনেক বেশি ফুটপাথ এখন তাদের দখলে। ফলে সাধারণ মানুষের হাঁটার জন্য কোনো জায়গা না পেয়ে মূল সড়ক ধরে তাদের হাঁটতে হয়। শুধু ফুটপাথ নয় কয়েকটি স্থানে দোকানিরা জায়গা না পেয়ে মূল সড়কেও অস্থায়ী দোকান বসিয়েছে। এর ফলে বেড়েই চলেছে জনভোগান্তি। অন্যদিকে গাড়ি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

 

রাজধানীতে যে পরিমাণ সড়ক থাকার কথা তা নেই। তবে যতটুকু আছে তার ৭০ শতাংশই হকাররা দখল করে আছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরের বর্তমান রাস্তার আয়তন ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক।

 

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সড়কে প্রাণ হারানো মানুষের ৪৩ শতাংশই পথচারী। এদের সবাই ফুটপাথে না চলে রাস্তা দিয়ে চলেছেন। এর মূল কারণ হলো ফুটপাথের সঠিক ব্যবহার না থাকা। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে ফুটপাথ থাকলেও তা থাকে হকারদের দখলে। এ ছাড়াও এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার মোট যাতায়াতের ৩৭ দশমিক ২ শতাংশই হয় পায়ে হেঁটে। আর সেই পায়ে হেঁটে চলার পথই চলে গেছে দখলদারদের কব্জায়।

 

একাধিক হকার জানান, দোকানের জন্য এখন আগের মতো টাকা দিতে হয় না। তবে কেউ কেউ টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে কাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে-সে বিষয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। কিন্তু আগের চেয়ে অনেক শান্তিতে ব্যবসা করতে পারছেন বলে জানান তারা। তা ছাড়া মার্কেটের সামনের ফুটপাথগুলো সেই কথিত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও জানান বেশ কিছু হকার। নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয় মার্কেটের সে ব্যবসায়ীকে।

 

জনভোগান্তির কথা স্বীকার করে নিউমার্কেট এলাকার হকার মফিজুর রহমান বলেন, আমাদের জন্য যদি নির্দিষ্ট কোনো জায়গা দেওয়া হয় তা হলে আমরা সেখানেই বসতে রাজি আছি। কারণ আমাদের পরিবার আছে তাই কিছু করতে না পারলে সন্তানদের নিয়ে চলতে কষ্ট হয়ে যাবে। সিটি করপোরেশনের লোক ও পুলিশ এসে প্রায়ই অভিযান চালায়। সে সময় চলে গেলেও পেটের দায়ে আবার এসে বসতে হয়। এখন আগের মতো কোনো নেতা বা প্রভাবশালীদের টাকা দিতে হয় না। তবে মাঝেমধ্যে এলাকার নেতৃস্থানীয় কিছু লোক এসে টাকা নিয়ে যায়।

 

নগরবাসীর অভিযোগ, ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রতিনিয়তই চলতে সমস্যা হয়। বাধ্য হয়ে মূল সড়ক ব্যবহার করতে হয়। গাড়ি চলাচলে বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি ঘটে নানা দুর্ঘটনাও। প্রতি বছর শত শত মানুষ বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়। ফুটপাথ হকারমুক্ত করতে না পারলে যানজট নিরসন সম্ভব না। এসব হকার থেকে পাওয়া বিশাল অঙ্কের টাকা কোথায় যায় তা সবার জানা।

 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, একটি শহরের জন্য আয়তন অনুযায়ী ২৫ শতাংশ রাস্তা দরকার। কিন্তু ঢাকার প্রধান সড়কগুলোর আয়তন মাত্র ৩ শতাংশ। আর বিভিন্ন অলিগলিসহ সর্বসাকুল্যে সড়ক রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রয়োজনের তিনভাগের একভাগ সড়কও নেই ঢাকায়। এর ওপর সব ফুটপাথ বেদখল হয়ে আছে। অধিকাংশ জায়গায় ফুটপাথ হকারদের দখলে। ৭০ শতাংশের বেশি ফুটপাথ হকাররা দখল করে রেখেছে। যদি ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে পারে তা হলে ২২ হাজার কোটি টাকা সরকারের সাশ্রয় হবে। যানজট কমার ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া রাস্তায় প্রায় ৭৫ শতাংশ জায়গা রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি দখল করে আছে। গণপরিবহন মাত্র ২৫ শতাংশ জায়গায় চলে। হকারদের কারণে মানুষ রাস্তায় চলে আর এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি গাড়ির জন্য আলাদাভাবে লেন থাকলে তখন এতটা সমস্যা হতো না।

 

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বলেন, ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা করার বিষয়টি এক দিনের ইস্যু নয়। দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলে আসছে। তাদের সকালে উচ্ছেদ করে দিলে দুপুরে আবারও বসে যায়। তবে প্রতিনিয়ত আমাদের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে পুলিশকে অভিযানের কাজে রাখা হচ্ছে। তবে আমাদের পাশাপাশি প্রশাসনের পর্যাপ্ত তদারকি থাকা দরকার। কারণ আমাদের একার পক্ষে সবকিছু ঠিক করা সম্ভব না। আমাদের সবার সমন্বিত উদ্যোগের ফলেই ফুটপাথকে হকারমুক্ত রাখা যাবে।

 

সিটি করপোরেশন মেয়র ছাড়া কখনো চলতে পারে না জানিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, গত ৫ তারিখের পর থেকে দেখার কেউ ছিল না বলে ফুটপাথ দখলের পরিমাণ বেড়ে গেছে। যদি সিটি করপোরেশন এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তা হলে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। সবার স্বার্থে হলেও কঠোরভাবে বিষয়টি দেখা প্রয়োজন।

 

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এ ক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে যিনি এসব ফুটপাথকে হকারমুক্ত রাখতে সহায়তা করবেন। পুলিশ আগেও ভালোভাবে কাজ করেনি। এখন আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছে না বলে এগিয়ে আসছে না। সম্প্রতি যারা নতুন করে ফুটপাথ দখল করেছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল। কোথায় হকার বসতে পারবে সেই জায়গাগুলো নির্দিষ্ট করা জরুরি। অন্যদিকে হকারদের তালিকা প্রস্তুত করা খুবই প্রয়োজন। তা হলে নতুন করে কেউ যেখানে-সেখানে বসতে পারবে না। হকারদের জন্য এখনই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে। নয়তো দিন দিন অবস্থার আরও অবনতি হবে।

Sharing is caring!