প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

উর্বরতা কমছে কৃষি খরচ বাড়ছে

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১১, ২০২৪, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ
উর্বরতা কমছে কৃষি খরচ বাড়ছে

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বাংলাদেশের কৃষি খাতের সংকট বেশ কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে। এ ক্রমবর্ধমান সংকটের সম্মুখীন হয়ে মাটির উর্বরতা কমছে, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব আরও জটিল হয়েছে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

 

জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের দক্ষতা কমে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ার ফলে কৃষি পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি সাধারণ মানুষের জন্য আরও বড় চাপ তৈরি করছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এই গবেষণাটি কৃষি খাতের এসব উদ্বেগজনক তথ্যগুলো তুলে ধরেছে।

বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো তাজনূর সামিনা খানম ‘বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা’ শীর্ষক নতুন গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত চার দিনব্যাপী বার্ষিক এবিসিডি সম্মেলনের শেষ দিনে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।

এই গবেষণাটি দেশের কৃষি উৎপাদনশীলতার প্রবণতা, কৃষকদের সম্মুখীন চ্যালেঞ্জ এবং খাতের প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপর প্রভাব সৃষ্টি করা বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে আলোকপাত করেছে।

 

গবেষণার ফলাফলগুলো বাংলাদেশের কৃষি খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জমির উৎপাদনশীলতার হ্রাস, উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার কমে যাওয়া। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, গবেষণাটি টেকসই উন্নতির পথ দেখিয়েছে। টেকসই কৃষি উৎপাদনের জন্য দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার, মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং উন্নত সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিকভাবে উন্নতি সম্ভব বলে মতামত এসেছে এতে।

 

এ ছাড়া, গবেষণায় প্রান্তিক কৃষকদের সমর্থন করা, পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিতকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট নীতির ওপর জোর দিয়েছে। সঠিক কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি খাত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন এ গবেষক।

 

কৃষি খাতের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেলে খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

 

গবেষণায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জমির উৎপাদনশীলতার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে বলে উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জমির উৎপাদনশীলতা ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু জমির ক্ষয় দেখা দেয় পরের দশক থেকে। গবেষণা তথ্য বলছে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জমির উৎপাদনশীলতা তীব্রভাবে কমে ২০১১-২০২০ সালে ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ২০১২-২০২১ সালে ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ হয়ে যায়। এই উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার পেছনে মাটি অবক্ষয় এবং দুর্বল কৃষি চর্চাকে দায়ী করা হয়েছে এ গবেষণায়।

কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা কমলেও কৃষি খাতের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। এ শ্রম উৎপাদনশীলতা প্রতি শ্রমিকের উৎপাদন পরিমাপ করে।

 

শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার বিবেচনায় গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এ খাতের উৎপাদনশীলতা শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ১০ বছরে কৃষকদের উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

তবে, এর পরবর্তী সময়ে এই প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হলেও প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। এ সময়ে শ্রম উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০০০ সালের পর এক দশক প্রবৃদ্ধি হলেও পরবর্তীতে ধারাবাহিক খাবে শ্রম দক্ষতার বৃদ্ধি কমে গিয়েছে।

 

মোট উৎপাদনশীলতা, যা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সম্মিলিত উপাদানের সঙ্গে মোট উৎপাদন তুলনা করে, ১৯৯০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬.৩২% গড়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। তবে, ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে টিএফপি প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ছিল এবং ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এটি হ্রাস পায়, যা অধিক উপাদান ব্যবহারের পরও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি।

ধান উৎপাদনের খরচ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত উৎপাদন খরচ ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়েছে, অথচ ধানের দাম সে তুলনায় বাড়েনি। এ ছয় বছরে ধানের দাম বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। এই ব্যবধানের কারণে কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমে গিয়েছে। কৃষকরা লাভ করতে না পারায় তাদের জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে।

 

গবেষণা অনুযায়ী, দেশের কৃষি খামারগুলোর গড় প্রযুক্তিগত দক্ষতা ৭৬ শতাংশ। যেসব খামারে ভালো সম্পদ, বড় আকার এবং উন্নত সংযোগ রয়েছে, তারা আরও বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে। তবে, জমি ভাগ করে কৃষি উৎপাদনের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে ইতিবাচকভাবে দেখা হলেও ২০১৫ সালের পর থেকে একটি নেতিবাচক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমি ভাগ করার ফলে উৎপাদনশীলতা এবং দক্ষতা কমে গিয়েছে।

ভূগর্ভস্থ পানি সেচ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দীর্ঘমেয়াদিভাবে অস্থিতিশীল এবং সেচ ব্যবস্থা কম কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি পানি ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।

 

ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর কৌশল গবেষণার ফলের ভিত্তিতে, কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কিছু কার্যকর কৌশল সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

প্রাথমিক কৃষি, উন্নত সেচ প্রযুক্তি এবং উন্নত বীজ প্রযুক্তির ব্যবহারে সম্পদ ব্যবহারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

নিয়মিত মাটি পরীক্ষণ, জৈব সার এবং ফসল ঘুরিয়ে চাষের পদ্ধতি মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধারে এবং জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

কৃষকরা মুনাফা বাড়াতে, এটি অত্যন্ত জরুরি যে কৃষির কাঁচামালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা, ব্যয়বহুল কৃষি যন্ত্রপাতি ও কীট নাশকের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং কৃষির মানোন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদান করা।

 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে কৃষকদের জন্য জলবায়ু স্মার্ট কৃষি পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে।

 

সরকারকে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, ভর্ভুকি এবং সম্মিলিত চাষের মডেলগুলোর সমর্থন প্রদান করতে হবে, যাতে সমতার সঙ্গে দক্ষতা নিশ্চিত করা যায়।

 

বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রতিবছর সমুদ্রের লোনা পানি প্রবেশ করে আবাদি জমি অনুর্বর করে ফেলে। এতে ফসলের উৎপাদন কমে যায় মারাত্মকভাবে। অন্যদিকে ওই অঞ্চলের প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র্যও সংকটাপন্ন।

 

 

Sharing is caring!