প্রজন্ম ডেস্ক:
সংসদে প্রায়ই শূন্যপদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। এরপর টানা কয়েক দিন সরকারি দপ্তরে, অভিভাবক মহলে আর বেকারদের আড্ডায় শূন্যপদ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মনে করে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো কাজ করে না বলেই যোগ্য লোক পাওয়া যায় না। অভিভাবক তুলোধুনো করে বেকার ছেলেকে। আর বেকার ভাগ্যকে দোষারোপ করে।
এখন সংসদ নেই। তাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেই শূন্যপদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সব মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভিন্ন সংস্থার মহাপরিচালক, করপোরেশনগুলোর চেয়ারম্যান, রেক্টর, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জনবল নিয়োগে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার। একই সঙ্গে লোক নিয়োগের কাজ বেগবান করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি শূন্যপদে জনবল নিয়োগে কাজ জোরদার করার জন্য পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই সময়ের জনপ্রশাসন সচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমদের চিঠিতেও ১৫ দিনের সময় দিয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর সেই সময়ের জনপ্রশাসন সচিব কেএম আলী আজমও একই ধরনের চিঠি পাঠান উল্লিখিত দপ্তরগুলোতে।
একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেকারদের এ দেশে শূন্যপদ একটা লোভনীয় বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলো চায় এ ইস্যুটা পুঁজি করতে। তাই তারা কয়েক দিন পরপরই শূন্যপদ পূরণের জন্য চিঠি পাঠাতেন। অন্তর্বর্তী সরকারের এটা দরকার ছিল না। এ সরকারের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ বিশেষ কিছু চায়। সরকার এক বছরে গড়ে ৪০ হাজারের বেশি শূন্যপদ পূরণ করতে পারে না। এ সরকারও পারবে না। পারতে হলে নতুন কিছু করতে হবে, তা না করে গতানুগতিক ধারায় হাঁটছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
শূন্যপদ পূরণের এ উদ্যোগ কি লোকদেখানো জানতে চাওয়া হয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার কাছে। জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, লোকদেখানো কি না, তা বলতে পারব না। তবে সরকারি চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার উদাসীন। অনেক সচিব চান না তার সময়ে লোক নিয়োগ হোক। কারণ এ প্রক্রিয়া শুরু হলেই প্রথম চাপটা আসবে মন্ত্রীর কাছ থেকে।
১০০ জন নিয়োগ করা হলে মন্ত্রী ৭৫ জনের একটা তালিকা ধরিয়ে দেন। এর বাইরে পাওয়ার হাউজগুলো তো রয়েছেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এমকি আত্মীয়স্বজনও তদবির নিয়ে হাজির হয়। তখন সংসারে অশান্তি শুরু হয় এবং পাওয়ার হাউজগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এসবের ফলে ডাম্পিং পদে বদলির সম্ভাবনা তৈরি হয় বা ওএসডি হতে হয়। নানামুখী ঝামেলার ভয়ে সচিবরা সাধারণত জনবল নিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর সচিব যদি আগ্রহ না দেখান, মন্ত্রী যতই চান না কেন, লোক নিয়োগ সম্ভব হবে না। কারণ সচিবই হচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্টিং অফিসার। এ কারণেই শূন্যপদের সংখ্যা কমে না, একই থাকে বা বাড়তে থাকে।
শূন্যপদ এত বেশি কেন জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘নিয়োগ কেন হচ্ছে না, সেটি আপনিও জানেন, আমিও জানি। এ বিষয়ে আর কিছু বলার নেই।’ মূলত রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দলীয় তদবিরকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে লাখ লাখ আবেদন জমা পড়ে। পরীক্ষার্থীও হয় লাখ লাখ। এই বিপুলসংখ্যক নিয়োগপ্রত্যাশীদের পরীক্ষা, খাতা মূল্যায়ন ও ফল প্রকাশের জন্য যে জনবল প্রয়োজন, তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের থাকে না। ফলে তৃতীয়পক্ষের সহায়তা নিতে গিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। বেশ কয়েকবার আউটসোর্সিং পদ্ধতিতেও নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়। তাতেও আশাব্যঞ্জক কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি।
সরকারি কর্মচারীদের যে তথ্য তুলে ধরেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সে হিসাবে শূন্যপদের সংখ্যা ৪ লাখ ৭৩ হাজার ১টি। এর মধ্যে বেতন স্কেলের ২০তম গ্রেডে সবচেয়ে বেশি লোক প্রয়োজন। এই স্কেলে শূন্যপদ রয়েছে ৭৮ হাজার ৮০৬টি। এরপরই আছে দশম গ্রেডের শূন্যপদ। যেখানে লোক প্রয়োজন ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। ১৬তম গ্রেডে ৬৫ হাজার ২৫৩, ১১ গ্রেডে ৫০ হাজার ৩৩, নবম গ্রেডে ৪০ হাজার ৫৯৬ জন। আর গ্রেড-১ ও গ্রেড-২-তে পদের চেয়েও বেশি লোকবল কর্মরত আছেন।
সরকারের জনবল নিয়োগের মূল উৎস হচ্ছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। সাংবিধানিক এ সংস্থাটি সর্বশেষ ৪৭তম বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৮৮টি শূন্যপদ পূরণের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। পিএসসি শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শূন্যপদ পূরণে জনবল সরবরাহ করে। এর বাইরেও নন-ক্যাডার এবং কিছু সীমিত পদে যোগ্য কর্মকর্তা বাছাই করে। সরকারি দপ্তরগুলো নিজেরাই বেশিরভাগ পদে জনবল নিয়োগ করে থাকে। আর এসব নিয়োগে ঘুষ লেনদেনসহ নানা ধরনের গুরুতর অনিয়ম হয়।
নিয়োগে সংকট কোথায় তা খানিকটা বোঝা যায় খাদ্য অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়োগ পর্যালোচনার মাধ্যমে। ২০১৮ সালে খাদ্য অধিদপ্তর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ২৪টি পদে মোট ১ হাজার ১৬৬ জনকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে ১৩ লাখ ৭২ হাজার ৮৪৫ প্রার্থী আবেদন করেন। লিখিত, মৌখিক পরীক্ষা শেষে সেই ফল আসে ২০২৩ সালের জুন মাসে।
২০১৮ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তৃতীয় শ্রেণির ইউনিয়ন সমাজকর্মীর ৪৬৩ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। তাতে আবেদন করেছিলেন ৬ লাখ ৬২ হাজার ২৭০ জন। ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এ পদে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার তিন দিন আগে তা স্থগিত করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। পরীক্ষার আগের দিন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবার তা স্থগিত করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পরপর দুবার এ পরীক্ষা স্থগিত হয়। পরে ২০২২ সালে লিখিত পরীক্ষা হয়। ২০২৩ সালে হয় মৌখিক পরীক্ষা। আর ফল প্রকাশ করা হয় একই বছরের ডিসেম্বরে।
দেড় বছর আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয় এবং একাধিক কর্মকর্তার জেল হয়। কিন্তু বেশিরভাগ অনিয়মের কোনো মামলা হয় না।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ বলছে, গত আট বছরে এখন সবচেয়ে বেশি বেকার। ২৬ লাখ ৪০ হাজার কর্মক্ষম মানুষের আয়ের জন্য চাকরি নেই। ২০১৩ সালের পর এখন রেকর্ড যে, দেশে বেকারত্বের হার ৩.৬৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পরিসংখ্যান যেমন সত্য, পাশাপাশি সরকারের শূন্যপদে লোকবল প্রয়োজন রয়েছে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ১টি। অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে সরকারের হাতে। তবুও দীর্ঘদিন কেন এ পদ পূরণ করা হচ্ছে না তা নিয়ে সংসদ ও সংসদের বাইরে হয়েছে বহু আলোচনা। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এবার এই প্রশ্ন তুলেছে খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সূত্রমতে, দেশে এখন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যাকে সেবা দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় হিমশিম খেতে হয় এই কর্মচারীদের।
লোকবল নিয়োগে সমাধান কী হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘১৯৭৪ সালের আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে দুটি কমিশন ছিল। একটি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির নিয়োগে কাজ করত। কমিশনের অন্য অংশ তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের দায়িত্ব পালন করত। চতুর্থ শ্রেণির দেখভাল হতো মন্ত্রণালয় বা বিভাগেই। ১৯৭৮ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে দুটি পিএসসি বিলুপ্ত করে বর্তমান পিএসসি গঠন করা হয়। এখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগ দেখে পিএসসি। আর বাকি অংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর হাতে। আর এতেই দুই শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পথ তৈরি হয়েছে।’
আগের মতো পিএসসিতেই দুটি কমিশনের অধীনে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করার প্রস্তাব দিয়ে সাবেক এ অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘একে তো পদের সংখ্যা কম কিন্তু আবেদন পড়ে অনেক। পাঁচ পদের জন্য তদবির আসে ৫০টা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজের চাকরি বাঁচাবেন না তদবির রাখবেন, এ সংকটেও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আগ্রহী হন না।’
Sharing is caring!