প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৫ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

পেশাজীবীদের কারণে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকদের বিপুল ক্ষতি

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ১০, ২০২৪, ১০:১০ পূর্বাহ্ণ
পেশাজীবীদের কারণে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকদের বিপুল ক্ষতি

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

দলীয় রাজনীতির কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন পেশাজীবীরা। শিক্ষক, আমলা, সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে সমালোচিত হচ্ছেন। আবার দলীয় পরিচয়ে বিভিন্ন অনিয়ম, সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে হয়ে পড়ছেন কোণঠাসা। অথচ নিরপেক্ষ ভূমিকার মাধ্যমে এসব পেশায় নিয়োজিতদের দেশের আর্থসামাজিকসহ নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। এই বিভক্তির কারণে এসব পেশা থেকে সর্বস্তরের জনসাধারণ যেভাবে উপকৃত হওয়ার কথা ছিল, সেটি ব্যাহত হচ্ছে। পেশাজীবীদের রাজনৈতিক বিভক্তিকে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম বলেন, ‘পেশাজীবীদের দলীয় পরিচয়ে বিভক্তি পেশার জন্য অশুভ। যদি রাজনৈতিক বিভক্তি না থাকত, তাহলে তারা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেকোনো সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারতেন। যৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু এখন দলীয় পক্ষ থাকার কারণে সরকার অন্য পক্ষের যৌক্তিক দাবিও আমলে নেয় না। এই বিভক্তির কারণে তারা নিজ পেশায় যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রেরও ক্ষতি হচ্ছে।’

 

 

শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত

 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শিক্ষকদের হেনস্তার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এ থেকে বাদ যায়নি। অনেককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। যারা এসব কাজে যুক্ত ছিলেন তাদের বক্তব্য হলো- তারা অতীতে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেক শিক্ষককে একাডেমিকভাবে বয়কটের ঘোষণা দেওয়া হয়। বর্তমানে শিক্ষার সব স্তরেই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধের কথা বলা হচ্ছে। শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

 

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষকতাও মহান পেশা। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা। তারা হবেন শিক্ষার্থীদের আইডল। তাদের অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকতে হবে, দলীয় কর্মীর চরিত্র ধারণ করা কোনোভাবেই উচিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত, প্রগতিশীল (বামপন্থি) শিক্ষকরা নীল, সাদা, হলুদ, গোলাপিতে এখনও বিভক্ত। অন্যদিকে কলেজ, স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকদের সংগঠনেও দলীয় লেজুড়বৃত্তি আছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোরও রয়েছে শিক্ষক সংগঠন। শিক্ষকরা দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারায় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। শিক্ষকদের এসব বিভক্তির কারণে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রমসহ শিক্ষার নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতেও চরম মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে।

 

 

আমলাদের বিভক্তিতেই তৈরি প্রশাসনিক জটিলতা

 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের নির্বাহী বিভাগের অংশ হলেন আমলারা। সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চাবিকাঠি হিসেবে ধরা হয় তাদের। আমলারা যদি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সুশাসন নিশ্চিত হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

স্বাধীনতার পর থেকে নব্বই সাল পর্যন্ত অনেকটা এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল, যা আমলানির্ভর। নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর নাগরিক রাষ্ট্রের প্রত্যাশা থাকলেও উল্টো আমলাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজনের প্রবণতা তৈরি হয়, যা মূলত দুই দলকেন্দ্রিক। অন্য দলের সমর্থক আমলাদের ওএসডি করার প্রক্রিয়াও বাড়তে থাকে। সেই থেকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সমর্থকদের বাইরের আমলাদের কোণঠাসা করে রাখেন। ক্ষমতার পালাবদলেও চিত্র থাকে একই। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও ব্যক্তির কাজের মূল্যায়নের চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে দলীয় আনুগত্য। এসব কারণেই গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সচিবালয়ে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। বিগত সময়ে নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে কর্মসূচি পালন করেন কর্মকর্তারা। তাদের অনেককে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

 

রাজনৈতিক এই বিভক্তির প্রভাব পড়ে ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বেও। অনেকটা দলীয় বিবেচনায় তারা এসব সংগঠনের নির্বাচনে অংশ নেন। দলীয়ভাবেই মন্ত্রণালয়সহ সর্বস্তরের একটা চেইন তৈরি করে ফেলেন। ফলে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।

 

অন্যদিকে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সব ক্যাডার নিয়োগ হলেও সরকারের বিভিন্ন কাজে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিই বেশি। এই ক্যাডারে পদোন্নতি আর সুযোগ-সুবিধা অন্য ক্যাডারগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে আন্তক্যাডার বৈষম্য। সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা বিধানের দাবিও জোরালো হচ্ছে।

 

এই দলীয় পরিচয়ই আমলাদের অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি করে দেয় বলে মনে করেন প্রশাসনসংশ্লিষ্টরা। ফলে সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের পর আমলাদের নানা অপরাধ সামনে আসছে। অনেক আমলাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনটা আগে দেখা যায়নি।

 

আইনজীবীদের বিভক্তিতে প্রভাব বিচারালয়ে

আদালত অঙ্গনেও রাজনৈতিক বিভক্তি প্রকট। এর প্রভাব পড়ছে বিচারালয়েও। রাজনৈতিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে আইনজীবীদের একাধিক সংগঠন রয়েছে। এমনকি, একই দলীয় আদর্শের দুটি সংগঠনও রয়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, ইসলামিক ল’ ইয়ার্স ফোরামের কার্যক্রম রয়েছে। এ ছাড়া আইনজীবীদের আরও চার থেকে পাঁচটি সংগঠন রয়েছে।

 

দলীয় বিভক্তির কারণে আদালত প্রাঙ্গণও উত্তপ্ত থাকে। অনেক সময় রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আইনজীবীদের দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে বিভক্তির কারণে বিচারকাজেও প্রভাব পড়ে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

দ্বিধাবিভক্ত সাংবাদিকরা, দাবি আদায়ে সমন্বয়হীনতা, ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকতা

সাংবাদিকতা পেশাকে বলা হয়ে থাকে ‘মহান পেশা’। অন্যতম কারণ এই যে অন্য পেশাজীবীদের পক্ষে যেটা সম্ভব না, সে রকম কর্মসম্পাদন করা যায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে সাংবাদিকতার মাধ্যমে চাইলে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজে ভূমিকা রাখা যায়। কিন্তু এখন উল্টো সাংবাদিক সমাজের মধ্যে নানা ধরনের বিভক্তি। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাংবাদিকতা। পেশাদার সাংবাদিক সংগঠন থাকলেও রাজনৈতিক আদর্শের কারণে একাধিক সাংবাদিক সংগঠনের পাশে লিখতে হয় ‘একাংশ’। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির পাশাপাশি দেশে রয়েছে বহু সাংবাদিক সংগঠন। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত রয়েছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)। অন্যদিকে বিটভিত্তিক সাংবাদিক সংগঠনেও রয়েছে বিভক্তি। এমনকি একটি বিটকে কেন্দ্র তিনটি সংগঠনও রয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, দেশে সংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টালের তালিকা যেভাবে বড় হয়েছে, তেমনিভাবে সাংবাদিকদের সংখ্যাও বেড়েছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনেকেই রাতারাতি সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হচ্ছে না। এই দ্বিধাবিভক্তির কারণে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর টেকসই উদ্যোগ কেউই নিতে পারছেন না। আবার কোনো সাংবাদিক আহত বা আক্রান্ত হলেও পাশে থাকতে পারছে না সাংবাদিকদের পুরো সমাজ। গত দেড় দশকে সাংবাদিক নির্যাতন কিংবা হত্যার ঘটনায়ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি বিভিন্ন সংগঠনকে। ফলে এখনো অধরা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর হত্যার বিচার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘এই বিভেদটা দীর্ঘদিনের। প্রেসক্লাবকে কেন্দ্র করে বিভেদ এমন পর্যায়ে গেছে যে অনেক জেলায় দু-তিনটা প্রেসক্লাব রয়েছে। এমনকি একই ভবনেও। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গণামাধ্যম নিয়ে সুনির্দিষ্ট পলিসি নিতে হবে। বর্তমানে গণমাধ্যম নিয়ে ৬০টির মতো পলিসি রয়েছে। কিন্তু একটি পলিসির (আমব্রেলা পলিসি) মাধ্যমে সেখানে শাখাভিত্তিক পলিসি নিতে হবে। এ জন্য এমন একটি সংস্থা বা কমিশন গঠন করা যেতে পারে যেখানে সাংবিধানিক পদ থাকবে, যা হবে দল নিরপেক্ষ। যারা বার কাউন্সিলের মতো সাংবাদিকদের যাবতীয় বিষয় নির্ধারণ করবে। এই পেশায় দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে হবে।’

 

 

স্বাস্থ্য খাতে স্বাচিপ বনাম ড্যাব, ব্যাহত চিকিৎসা সেবা

স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তারদের রাজনৈতিক বিভক্তিও চরমে। ক্ষমতার পালাবদলে চলে আওয়ামী লীগপন্থি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এবং বিএনপিপন্থি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর দাপট। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে স্বাস্থ্য খাতের সবকিছুই ছিল স্বাচিপের নিয়ন্ত্রণে। কোথাও ছিল অভ্যন্তরীণ বিরোধ। ২০১৩ সালে শিশু হাসপাতালে তৈরি হয়েছিল অচলাবস্থা। গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর স্বাচিপের জায়গায় ড্যাবের ডাক্তারদের কর্মতৎপরতা বেড়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে থাকা ডাক্তাররা হাসপাতাল ছাড়েন। কোয়ার্টারও ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান অনেকেই। এর ফলে দারুনভাবে ব্যাহত হয়েছে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক বলেন, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি কত নিম্নপর্যায়ে গেলে ডাক্তারের মতো মানবিক পেশার লোকজনকেও হাসপাতাল ছাড়তে হয়। দলীয় লেজুড়বৃত্তি বাদ দিয়ে নিজের পেশাগত কাজে সক্রিয় থাকলে এসব পেশাজীবী দেশের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতেন।’

 

 

রাজনৈতিক দলাদলিতে বাদ নেই প্রকৌশলীরা

প্রকৌশলীরাও দলীয় সমর্থন নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) এবং ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইডিইবি) নির্বাচনে অংশ নেন। এই দলীয় বিভক্তির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানেও অচলাবস্থা তৈরি হয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এ সেক্টরে আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ এবং বিএনপি-সমর্থিত ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (অ্যাব)’ সক্রিয় রয়েছে।

Sharing is caring!