প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

অসন্তুষ্ট বিদেশি এয়ারলাইন্স

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১০, ২০২৪, ০৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ
অসন্তুষ্ট বিদেশি এয়ারলাইন্স

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিয়েও নির্ধারিত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও কার্গো সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর। এ জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করে পাওনা সেবা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

 

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বলতে যাত্রীর বোর্ডিং পাস ইস্যু, ব্যাগেজ আনা-নেওয়া, কার্গোর মালামাল ওঠানো-নামানো এবং এয়ারক্রাফটের সব ধরনের সার্ভিসকে বোঝায়। ১৯৭২ সাল থেকে দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে আসছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। নিজেদের ফ্লাইটের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ৩৫টির মতো এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সেবা দিচ্ছে তারা (ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও এয়ার অ্যাস্ট্রা ছাড়া)।

 

এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার জন্য বিশ্বের অন্য দেশের চেয়ে বেশি ফি দিয়েও কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রয়োজনীয় জনবল, সরঞ্জাম ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট ছাড়া ও যাত্রীসেবা নিশ্চিতে নিজেদের স্টাফ নিয়োগ করে কাজ চালাতে হচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলোকে। এতে এয়ারলাইন্সের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে টিকেটের মূল্যে।

 

শুধু যাত্রীসেবা নয়, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দুর্বলতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কার্গো পরিবহন ব্যবসাও। দেশে ৮টি কার্গো এয়ারলাইন্সের কার্যক্রম থাকলেও রফতানিকারকরা কার্গোর বড় একটি অংশ সড়কপথে ভারতের বিমানবন্দরগুলোয় পাঠায় প্রসেসিং ও শিপমেন্টের জন্য। এয়ারলাইন্সগুলোর অভিযোগ, সেবা দিতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠান বিমানের সঙ্গে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর যে সার্ভিস লেভেল এগ্রিমেন্ট (এসএলএ) রয়েছে, তার বিন্দুমাত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে না, যা সেবার জন্য এয়ারলাইন্সগুলো থেকে নেওয়া ফির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। উল্টো উড়োজাহাজে মালামাল ওঠানামা করার জন্য নিজেদের উদ্যোগেই জনবল নিয়োগ দিতে হচ্ছে। এটি বিমানবন্দরে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কাও তৈরি করছে।

 

বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক এয়ারলাইন্স এয়ার অ্যারাবিয়া যাত্রীদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার জন্য প্রতি ফ্লাইটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করে। কার্গোর জন্য প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত শূন্য দশমিক শূন্য সাত সেন্ট (মার্কিন ডলার) চার্জও প্রদান করে। এসব ব্যয় সত্ত্বেও বিমান তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মাত্র দুই থেকে তিনজন কর্মী দেয়।

 

বিমানবন্দরে একটি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি স্টেশন ম্যানেজার বা কাউন্টার সুপারভাইজারই যথেষ্ট। তবে বিমানের পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় এয়ার অ্যারাবিয়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩০ জনেরও বেশি নিজস্ব কর্মী নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। একইভাবে ইন্ডিগো এয়ার বিমানবন্দরে ২৫ জন এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ৬০ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

 

বর্তমানে শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করছে। দুই বছরের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ (থার্ড টার্মিনাল) এর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ভালো সার্ভিস দিতে ব্যর্থ হলে দুই বছর পর কেড়ে নেওয়া হবে দায়িত্ব এমন কথা উল্লেখ করে তাদের দায়িত্ব দিয়েছে সরকার।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের কোথাও কোনো একটি সংস্থা এককভাবে বিমানবন্দর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে না। কিন্তু বাংলাদেশে বিমান একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থার দাবি তুলে দেশের সব বিমানবন্দর এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এখন তারা শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করবে। তারা রাতারাতি কীভাবে সেবা উন্নত করবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একাধিক কোম্পানিকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দেওয়ার দায়িত্ব দিলে সেবা উন্নত হবে। তারপরও কেন সরকার সে পথে হাঁটছে না, সেটি বড় প্রশ্ন।

 

এয়ারলাইন্স অপারেটরস কমিটির (এওসি) ঢাকার চেয়ারপারসন দিলারা হোসেন বলেন, ঢাকা বিমানবন্দরের বিমানকে দেওয়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ প্রতিবেশী দেশ এমনকি পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। বিমানের শিফট পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত খারাপ। তারা চেক-ইন কাউন্টার, গেট, র্যাম্প, লোডিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত স্টাফ দিতে পারছে না।

 

এত চার্জ দেওয়ার পরও প্রতিটি বিদেশি এয়ারলাইন্সকে বিমানবন্দরের নানা কাজের জন্য কমবেশি ৭০ জন করে নিজস্ব জনবল নিয়োগ দিতে হচ্ছে। এতে এয়ারলাইন্সগুলোর অপারেশনাল ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা টিকেটের দামের ওপর প্রভাব ফেলছে। ভালো সার্ভিস দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠানের (বিমান) সঙ্গে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর যে সার্ভিস লেভেল এগ্রিমেন্ট ছিল তার বিন্দুমাত্র বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

 

কাতার এয়ারওয়েজের কার্গো ম্যানেজার সুহেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিমানকে পয়সা দিয়েও সেবা পাওয়া যায় না। আমরা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ফি দিলেও বিমানবন্দরে কাতার এয়ারের ৮২ জন স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যে কাজ বিমানের করার কথা সে কাজ আমাদের নিজেদের লোক দিয়ে করাতে হচ্ছে। তারা পয়সা নিয়েও সেবা দিচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী কাজ করছে না। এখন বেশি কিছুর দাবি নেই। আমরা শুধু চাই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমানের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, তারা সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করুক।

 

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম জানান, বিমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তারাশাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবে, তা বলা যায় না।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, বিমানকে দুই বছরের জন্য থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে ভালো সার্ভিস দিতে ব্যর্থ হলে দুই বছর পর কেড়ে নেওয়া হবে। এ থেকেই তো বোঝা যায় তারা কতটুকু সক্ষম।

 

এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) সেক্রেটারি জেনারেল ও নভোএয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, সম্প্রতি বিমানের জিম্মায় তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দুই বছরের জন্য প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জোর বিতর্ক চলমান এবং তা যৌক্তিক। তৃতীয় টার্মিনাল অপারেশনের ক্ষেত্রে বর্তমান একচেটিয়া ব্যবস্থা ভেঙে একাধিক কোম্পানিকে সুযোগ দিলে সেবা উন্নত হবে এবং দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। বিমানকেও জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যোগ্য বিবেচনায় দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।

 

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানের পরিচালক (কাস্টমার সার্ভিস) হায়াত-উদ-দৌলা খান বলেন, ১ ডিসেম্বর থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং অ্যাক্টিভিটি পর্যালোচনার জন্য ম্যানপাওয়ার, ইকুইপমেন্ট, ট্রেনিংসহ ডিটেইল অ্যাকশন প্ল্যান দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল পরিচালনায় বিমানের কিছু সমস্যা রয়েছে। চেক-ইনে যে জনবল দরকার তা আমরা দিতে পারি না। কিছু ইকুইপমেন্টের শর্টে আছি। পূর্ণাঙ্গ অপারেশনের আগে আমরা এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বসব। আশা করছি তৃতীয় টার্মিনালে আমরা সবাইকে কাক্সিক্ষত সার্ভিস দিতে পারব।

 

জানা গেছে, বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে ৩৬টি বিদেশি কমার্শিয়াল এয়ারলাইন্স, ৮টি কার্গো এয়ারলাইন্স, ৪টি দেশীয় এয়ারলাইন্স, হেলিকপ্টারসহ ১৩টি এভিয়েশন প্রতিষ্ঠান ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বিমানবন্দরের ১ এবং ২ নম্বর টার্মিনাল সবশেষ ২০২৩ সালে বিমানবন্দর ৯৫ লাখ যাত্রী হ্যান্ডল করেছে। নতুন টার্মিনাল অর্থাৎ তৃতীয় টার্মিনালের ফলে যাত্রী হ্যান্ডলের সক্ষমতা দুই কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। এ ছাড়া কার্গো সক্ষমতা ২ লাখ টন থেকে বেড়ে ৫ লাখ টন হবে।

Sharing is caring!