প্রজন্ম ডেস্ক:
আমদানিতে ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট বা এলসি) নিষ্পত্তি ও নতুন ঋণপত্র খোলার হার কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিকারকদের অনুকূলে বিভিন্ন নীতি-সুবিধা দিলেও আমদানিতে গতি বাড়ার মতো কোনো সুখবর নেই। এই পরিস্থিতিতে দেশে শিশুখাদ্যসহ আগামী রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, আমদানিনির্ভর একটি দেশে বিদ্যমান এ পরিস্থিতি অর্থনীতির বহুমাত্রিক দুর্বলতার ইঙ্গিত বহন করে। এর মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যে দেশের আর্থিক মানের অবনতি, উৎপাদন ও সরবরাহে স্বল্পতা এবং অব্যবস্থাপনা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাস এবং এর প্রভাবে সার্বিক চাহিদা কমে যাওয়া।
খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ অন্য সবকিছুর চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৬৭২ কোটি (৬৬ দশমিক ৭২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১৭ কোটি (১৬ দশমিক ১৭ বিলিয়ন) ডলার।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সার্বিক আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং নতুন ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমেছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভোগ্যপণ্য আমদানিতে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং নতুন ঋণপত্র হ্রাস পেয়েছে ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং নতুন ঋণপত্র কমেছে ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমিডিয়ারি গুডস) আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং নতুন ঋণপত্র খোলা কমেছে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমদানি আগেও যা হয়েছে তার পরিমাণ কম ছিল। এ জন্য নিত্যপণের বাজারে অস্থিরতা কমাতে পারেনি বিগত সরকার। এখন যে পরিমাণ আমদানি হচ্ছে তার পরিমাণও কম। এর অর্থ হলো- অর্থনীতি দুর্বল অবস্থায় আছে, এটা তারই ইঙ্গিত। আগে কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারসংকট। এ কারণে বিগত সরকারের সময়ে আমরা দেখেছি আমদানি সংকোচন করা হয়েছিল। এলসি মার্জিনও ছিল। কিন্তু এবার আমরা কী দেখছি? বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে। ফলে নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। তার পরও আমদানিতে আশানুরূপ গতি ফিরছে না। এর অর্থ হলো চাহিদা কমেছে। এর কারণ দুটি। এক. উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। খাদ্য কিনতে খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে। এটা কে কতটুকু পারে? নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ তো খাদ্যের বাইরে চিকিৎসা ও সন্তানের লেখাপড়া বাবদ ব্যয় করে। তারা ওই সব ব্যয় কমাতে পারে না। বাধ্য হয়ে খাদ্য ব্যয়ে তারা লাগাম টেনেছে। তারা কম ভোগ করছে বা চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। দুই. আমদানিকারক এবং তার ব্যাংক বৈদেশিক ঋণ (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) পাচ্ছে না। কারণ থার্ড পার্টি হিসেবে যারা ঋণ দেয়, তারা এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আশানুরূপ কিছু পাচ্ছে না। এর ফলে আমদানিকারকদের জন্য সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পাওয়া সহজ হচ্ছে না।’
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমদানির তথ্য বলছে, দেশের অর্থনীতি সচল হয়নি। এর কারণ কী? আপনি যদি পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে, মার্কেটে নিরাপত্তার অভাব দেখেন, তাহলে আপনি কী করবেন? বাইরে যাবেন না। কাজ করবেন না। আয় করবেন না। ভোগ কম বা ত্যাগ করবেন। বিনিয়োগ নিয়ে ভাবনা বাদ দেবেন। এই তো হবে। তাই হচ্ছে। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে সবার আগে। আমাদের ইতিবাচক দুটি সূচক আছে। এর একটি হলো রেমিট্যান্স এবং অন্যটি রপ্তানি। সুতরাং নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে এনফোর্সমেন্ট পর্যন্ত দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতি আপনাআপনি সচলতার দিকে এগিয়ে যাবে।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নানা কারণে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি বড় আন্দোলন গেছে। সেই সময়ে পরিবহন, সরবরাহ ও উৎপাদনে একটা স্থবিরতা ছিল। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা- এসব কিছুর কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকটা মন্দ গেছে। আশা করা যায় দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বরে পরিস্থির কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তবে অর্থনীতি যে ভালো নেই, নানাবিধ চ্যালেঞ্জ আছে, তা তো স্পষ্ট। তাই অর্থনীতি আগের অবস্থায় যেতে সময় লাগবে।’
এদিকে বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষকেই শুধু নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। আসছে রোজায় যদি সরবরাহ সংকটের নাম করে আরেক দফা দ্রব্যমূল্য বাড়ে, তাহলে পরিস্থিতি বিরূপ হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘আমদানিতে একটা শ্লথ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই বার্তা আমরা বিভিন্নভাবে নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। এখানে গতি আনতে হবে। আগামী রোজার চাহিদা পূরণের জন্য সব ধরনের পণ্য ডিসেম্বরের মধ্যেই আমদানি নিশ্চিত করা ভালো হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা শিখা জানান, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোক্তাপণ্যের আমদানিতে শূন্য মার্জিনে ঋণপত্র খোলা এবং সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণে আমদানি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এই মুহূর্তে আমদানি একটি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে এবং বছরের সার্বিক আমদানি পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে মর্মে আশা করা যাচ্ছে।’
Sharing is caring!