প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

আদানির বিদ্যুতে মেগা ‘শুল্ক ফাঁকি’, পদে পদে অনিয়ম

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০২:৫১ অপরাহ্ণ
আদানির বিদ্যুতে মেগা ‘শুল্ক ফাঁকি’, পদে পদে অনিয়ম

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বেরিয়ে আসছে ভারতের বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে পদে পদে অনিয়মের তথ্য। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ আমদানিতে এক বছরে অন্তত ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার শুল্ক ‘ফাঁকির’ প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ কেনার এ চুক্তির সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে শুল্ক ও কর অব্যাহতি।

এছাড়া আমদানি করা বিদ্যুতের তথ্য যুক্ত করা হয়নি অ্যাস্যাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম ও কাস্টমসের এমআইএস-এ। শুল্ক গোয়েন্দার ওই প্রতিবেদনের একটি কপি জাগো নিউজের সংগ্রহে রয়েছে। তবে এ বিষয়ে আদানি গ্রুপের তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

এরই মধ্যে আদালত আদানি গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা সব বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

 

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করেছে। যেখানে আদানি পাওয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত ১১টি চুক্তি খতিয়ে দেখা হবে। যার মধ্যে আদানি পাওয়ারের নির্মিত প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টও রয়েছে।

 

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমদানি চুক্তিতে ত্রুটি ও খুঁটিনাটি খুঁজে বের করতে আট সদস্যের কমিটি করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের শীর্ষ শিল্পপতি গৌতম আদানির মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানি আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনেছে।

আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের সঙ্গে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিতে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে আদানি পাওয়ার। ২০২৩ সালের ৯ মার্চ গড্ডা থেকে আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন শুরু হয়।

 

 

আদানির বিদ্যুৎ দেশে এনে জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে বিশেষ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় দুটি সাব-স্টেশন ও অন্যান্য সঞ্চালন স্থাপনা নির্মাণ করেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।

গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কিনতে বাংলাদেশের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম নেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। যা নিয়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুপক্ষের মধ্যে বৈঠক হয়।

 

যা আছে প্রতিবেদনে

গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, এতে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কি না; এসব প্রশ্ন সামনে রেখে তদন্ত শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দারা। প্রতিবেদনে কর ফাঁকির এই অর্থ পিডিবির কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করেছে শুল্ক গোয়েন্দাদের এ কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সাল থেকেই আমদানি করা এ বিদ্যুতের শুল্কসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালনের সময় আমদানির যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি।

শুল্ক ‘ফাঁকির’ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, এনবিআরের চিঠি পেয়েছি। বিষদভাবে চুক্তিটি বিশ্লেষণ করছি। এটি নিয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব না। পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।

শুল্ক ‘ফাঁকির’ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, এনবিআরের চিঠি পেয়েছি। বিষদভাবে চুক্তিটি বিশ্লেষণ করছি। এটি নিয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব না। পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।

২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় এনবিআর ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে শুল্ক অব্যাহতি দিয়েছে পিডিবি। যদিও কর, শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার এখতিয়ার শুধুই রাজস্ব বোর্ডের।

চুক্তির আওতায়, ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির কেন্দ্র থেকে ১০৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যার মূল্য ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার।

এর বিপরীতে ৩১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও বিভিন্ন কর মিলে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর পাওয়ার কথা। আর চুক্তিতে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হলেও সেটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি এনবিআর থেকে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এটিকে বলা হচ্ছে ‘ফাঁকি’।

 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমদানি করা বিদ্যুতের শুল্ক-কর মওকুফ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ছিল কি না এবং থাকলে এ বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি হয়েছে কি না, জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দাকে লিখিত জবাব দেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।

সেখানে বলা হয়, আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেড ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিভাগ ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আদানির বিদ্যুতের ওপর থেকে প্রযোজ্য যাবতীয় শুল্ক ও কর মওকুফের আবেদন করেন। এক্ষেত্রে এর আগে ভারতীয় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেডকে দেওয়া অব্যাহতির কথা জানানো হয়।

 

যদিও পরে শুল্ক অব্যাহতি ও প্রকল্প সুবিধা শাখা থেকে অব্যাহতি প্রদানের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি রাজস্ব বোর্ড। চুক্তি সম্পাদনের আগে এনবিআরের কোনো মতামত নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।

 

কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন শুল্ক স্টেশন বা হাউজ দিয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি হয়েছে তারও খোঁজ নিয়ে কমিটি দেখতে পায়, এ যাবত ‘কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিল এবং তা আইনানুগ পন্থায় নিষ্পত্তি হয়নি’। প্রতিবেদনে বলা হয়, যে রুট (রহনপুর শুল্ক স্টেশন, রাজশাহী) দিয়ে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশে প্রবেশ ও সঞ্চালন করা হচ্ছে, তা কাস্টমস আইন, ১৯৬৯ বা কাস্টমস আইন, ২০২৩-এর আওতায় ‘কাস্টমস স্টেশন হিসেবে অনুমোদিত বা ঘোষিত স্থান নয়’।

যে রুট ব্যবহার করে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন করা হচ্ছে, ওই স্থানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাস্টমস আইন, ২০২৩-এর আওতায় কাস্টমস স্টেশন হিসেবে ঘোষণা করার পরামর্শ দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।

এছাড়া অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম যাচাই করে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করার প্রমাণ পায় এনবিআর। বিদ্যুতের শুল্কায়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে রাজস্ব বোর্ডের কোনো দপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে।

সেখানে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ও আদানি গ্রুপের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য বছরভিত্তিক ভিন্নতা রয়েছে। বিদ্যুৎ আমদানিতে এনবিআর কোনো শুল্ক অব্যাহতি দেয়নি। ফলে এই শুল্ক আদায়যোগ্য।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, যেহেতু বিদ্যুৎ অন্যবিধ কোনো পণ্যের অনুরূপ নয়; ফলে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে কোন প্রক্রিয়ায় বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হবে তা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারে। এনবিআরের আদেশ না থাকা সত্ত্বেও শুল্ক-কর পরিশোধ না করে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি করায় যে শুল্ক-কর ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে পিডিবি এর দায় এড়াতে পারে না।

এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে প্রযোজ্য শুল্ক-কর পরিশোধের নির্দেশনা এবং কাস্টমস আইন অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

Sharing is caring!