প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের কোথাও না কোথাও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মাঠে নামছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দাবি আদায়ে রাস্তা দখল করে বিক্ষোভ, অবরোধ, মিটিং, মিছিল ও ঘেরাও করছে। অনেক সময় বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করছে। জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটছে। বিঘিœত হচ্ছে নিরাপত্তা। রোববারও দিনব্যাপী ঢাকায় হামলা, ভাঙচুর, গণঅবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি চলেছে। কোনোভাবেই যেন অস্থিরতা কমছে না-রেহাই মিলছে না প্রতিদিনের দুর্ভোগ থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে সবাই। কোনো দাবি থাকলে নিয়ম মেনে করতে হবে। জনদুর্ভোগের কারণ হয়, সে ধরনের কর্মকা-ে কঠোর হতে হবে। দ্রুত শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি বলে মনে করেন তারা। সোমবার সকাল থেকে রাজধানী ঢাকায় একইরকম বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ, কথিত অহিংস আন্দোলনসহ ব্যাটারী চালিত এবং অটোরিক্সা চালকদের দফায়-দফায় বিক্ষোভে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে (ডিএমআরসি) হামলা, ভাঙচুর করছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতির জেরে এ ঘটনা ঘটে।
সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকাল ১০টা থেকে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হতে থাকে। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রায়সাহেব বাজারের দিকে অগ্রসর হয় সাত কলেজের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জড়ো হতে থাকে।
পরে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কিছু শিক্ষার্থী ওই কলেজে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে হামলা, ভাঙচুর এবং ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় রাস্তার বিপরীত পাশে মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতাল, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাড়ি, ক্লাসরুম ও অফিস থেকে শুরু করে হামলা থেকে কোনো কিছুই বাদ যায়নি। এ পরিস্থিতিতে কলেজে চলমান স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘গণঅবস্থান’ কর্মসূচি পালন করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। এতে ওই এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দেয়। সকাল ১০টা থেকে একটি ট্রাককে মঞ্চ বানিয়ে তারা ‘গণঅবস্থান’ কর্মসূচি পালন করেন। দুপুর সোয়া ১টার দিকে তারা সড়ক ছেড়ে দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একদল কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের সামনে দুই ডেপুটি গভর্নরের পদত্যাগের দাবিতে এই বিক্ষোভ চলে। তার আগে আন্দোলনকারীদের ৪০ সদস্যের একটি দল সকালে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেখা করে দুই ডেপুটি গভর্নরকে সরানোর দাবি জানিয়ে আসেন।
এর পাশেই বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সালেহউদ্দিনের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামে এস আলম নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্ণফুলী থানা এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান সড়ক অবরোধ করেন। কয়েকশ চাকরিচ্যুত ব্যাংক কর্মকর্তা বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে এবং অনেকে কাফনের কাপড় পরে সড়কে অবস্থান নেন। এতে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। পোশাক শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে প্রায়ই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। গতকালও বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয় এলাকায় বিক্ষোভ ও মিছিল-মিটিংও নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও মিছিল বা বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছে। গত সপ্তাহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন। সেটি সমাধান করতে না করতেই তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এর আগে ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন। এরপর তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ সংলগ্ন এলাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাজধানীর জুরাইনে রেললাইন অবরোধ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা।
সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির চতুর্থ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে করণীয়, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সার্বিক নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়, সড়কে অটোরিকশা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা, বিজয় দিবস উদ্যাপন, দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার, ভুয়া মামলার মাধ্যমে হয়রানি বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ, সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে করণীয় ও মাদক নিয়ে আলোচনা হয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের বিষয়টি উচ্চ আদালতের এখতিয়ারাধীন। উচ্চ আদালতের আদেশকে আমরা বাস্তবায়ন করছি। উচ্চ আদালত থেকে এই বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে নির্দেশনা আসার কথা। নির্দেশনা পেলে সে মোতাবেক আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
ভুয়া ও মিথ্যা মামলার মাধ্যমে হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, ভুয়া এবং মিথ্যা মামলা যেন না হয় সে বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ ধরনের মিথ্যা মামলায় যারা আসামি হয়েছেন তারা যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন সে জন্য আমরা একটি কমিটি করে দিচ্ছি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যেকোনো কিছু নিয়েই রাস্তায় নামছে মানুষ। জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটছে। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, পরীক্ষা চলছিল। দুপুর সোয়া ১টার দিকে কিছু বোঝার আগেই সিসি ক্যামেরাতে দেখি গেট ভেঙে প্রচুর ছেলেমেয়ে ঢুকেছে। ইচ্ছেমতো ভাঙচুর করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের মার্কশিট, খাতা ও ল্যাপটপ কিছুই নেই। তিনি বলেন, এ তা-ব যারা চালিয়েছে তারা কী ছাত্র হতে পারে? এত নাশকতা তো কোনো ছাত্র করতে পারে না।
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালের চিকিৎসক ফেরদৌস আহম্মেদ বলেন, হাসপাতালে এভাবে হামলা কাম্য নয়। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আলোচনার সুযোগ রয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, পুলিশের অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি উত্তপ্ত পরিস্থিতি-উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণ করা এখন পুলিশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতিনিয়ত বোঝানোর চেষ্টা করছি যে যদি কারও কোনো যৌক্তিক দাবি থাকে তা হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কারণে-অকারণে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
Sharing is caring!