স্টাফ রিপোর্টার:
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের খসড়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করলেও শেষ মুহূর্তে পিছু হটল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আলাপ-আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে আনা প্রস্তাবটি বাদ দিয়ে আজ বুধবার আইনটি খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে পাস হয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
আজ বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের খসড়ায় সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান ছিল। সেখানে বলা ছিল, কোনো সংগঠনকে শাস্তি দেওয়া দরকার মনে করলে ট্রাইব্যুনাল উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে শাস্তির সুপারিশ করতে পারবে।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘কিন্তু আজকে আমাদের উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা এই বিচারকে অন্য কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চাই না। রাজনৈতিক দল বা কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন এলে এই আইনকে অযথাই প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না। আমরা একদম ডিসেন্ট ওয়েতে, ফেয়ার ওয়েতে বিচারটা করতে চাই। এই জন্য এই প্রভিশনটা বাতিল করা হয়েছে।’
আইন উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘আরেকটা বিষয় আমরা অনুভব করেছি, কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো সংগঠনকে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য যদি নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হয় বা দাবি উঠে, তাহলে আমাদের অন্যান্য আইনে নিষিদ্ধ করার বিধান রয়েছে, সন্ত্রাস দমন আইনে রয়েছে, নির্বাচনী আইনে রয়েছে। ১৯৭৯ পলিটিক্যাল পার্টিজ অ্যাক্টে সেই সুযোগ রয়েছে।’
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান রাখাসহ বেশ কিছু বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়। খুন, গুম, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কোনো দল বা সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হলে সেই দল বা সংগঠনের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলের সুপারিশে বিধান ছিল খসড়ায়।
তবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব নিয়ে আইনজীবীদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, দেশে ভিন্ন একটি আইনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। এরপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে এ ব্যাপারে বিধান যুক্ত করা হলে, তা বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। তাদের শাসনের পতনের আন্দোলনে সরকারি হিসাবে ৮৭৪ জন নিহত হন। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ ওঠে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যা ও আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ে গুমের অভিযোগগুলোর বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে বিচার কার্যক্রমের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আইনটি সংশোধনের।
সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, সংশোধনী প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে অল্প সময়ের মধ্যে তা অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা হবে। যেহেতু দেশে এখন সংসদ নেই। এই অধ্যাদেশের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৪’।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ করা হয়েছিল। এই আইনে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচার কার্যকর করে আওয়ামী লীগ সরকার। একই অপরাধ সংগঠন বা দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য তখন গণদাবি উঠেছিল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিধান রেখে এই আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে দীর্ঘদিন গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত তা পাস করেনি।
কিন্তু পতনের আগে শেষ সময়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেই নিষিদ্ধাদেশ প্রত্যাহার করে। এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। সেই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে দলটিরও বিচার দাবি করে সরকার পতনের আন্দোলনে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আরও বলেন, ‘এই আইনে (আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন) এই বিধান নাই বলে, আমাদের জনগণের দাবির প্রতি বা জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আর থাকল না, তা নয়। সেটা যুদ্ধাপরাধ আইনে থাকল না, সেটা অন্য আইনে রয়েছে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হলে পরে বিবেচনা হবে। সেটা এই আইনের ভেতরে অন্তর্ভুক্তির বিষয় না।’
Sharing is caring!