প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ভেঙে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশের চেইন অব কমান্ড। গণঅভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়ে এই বাহিনীটি। থানায় থানায় হামলা, অগ্নি সংযোগ, মারধর ও হত্যার ঘটনা ঘটে। অভ্যুথানে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। সুবিধাভোগী অনেক পুলিশ সদস্য আত্মগোপনে চলে যান, অনেকে গ্রেপ্তার হন।
জনগণের সবচেয়ে কাছাকছি থাকা বাহিনীটি এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পর সারা দেশে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশকে পেশাদার ও জনমুখী সংস্থায় পরিণত করতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ইতোমধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যেই ধীরে ধীরে স্বরূপে ফিরছে পুলিশ। জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। নানা কারণে বিতর্কিত এবং আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশকে রাজনৈতিক ব্যবহারে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের কাউকে কাউকে সরানো হয়েছে আর কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে।
এদিকে রদবদলের স্রোতে ঢাকার পুলিশ একরকম ‘ধুয়ে-মুছে সাফ’ হয়েছে। ঢাকা থেকে বদলি হয়েছে পুলিশের সিংহভাগ সদস্য। এতে নাগরিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চাপ সামলাতে পারছে না বাহিনীটি। হুট করে বেড়ে যাওয়া চুরি-ডাকাতি ও নারী-শিশু নির্যাতন ঠেকাতে বেগ পেতে হচ্ছে। মামলা তদন্তেও ধীরগতি চলছে।
পুলিশের ক্রাইম ডিভিশনে কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বলা যায় ধুয়ে-মুছে সাফ করা হয়েছে ঢাকার পুলিশ। এখন বেশিরভাগই নতুন কর্মকর্তা। জেলা শহরের অপরাধের ধরন এবং ঢাকার অপরাধের ধরন আলাদা। অপরাধের ধরন বুঝতেই সময় চলে যাচ্ছে। খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগছে।’
তিনি বলেন, ‘সোর্স-নির্ভর মাঠ পুলিশের জন্য অপরাধী শনাক্ত করা এবং আগাম তথ্য পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।’
বেড়েছে নারী-শিশু নির্যাতন
পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে হুট করে বেড়েছে নারী-শিশু নির্যাতন। মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেপ্তারে ধীরগতি রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু আইনে ১২৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার প্রায় অর্ধেক ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগের। এর মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে ৪৩৩২টি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ১৮৭০টি মামলা হয়।
এছাড়া যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ঘটনায় ৩২০৮টি, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপের কারণে ৪৭টি, অপহরণের ঘটনায় ৩২৮৭টি এবং শিশু অপহরণের অভিযোগে ২৫টি মামলা হয়েছে। এছাড়া যৌতুকের কারণে ১৩৬ নারী এবং ধর্ষণের পর ১২ নারী ও ১১ শিশু হত্যার শিকার হয়েছেন।
চুরি-ডাকাতি ও প্রকাশ্য ছিনতাই বেড়েছে
৫ আগস্টের পর সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বাসা-বাড়িতে চুরি-ডাকাতি ও রাস্তায় প্রকাশ্যে ছিনতাই ঠেকাতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে বিপুলসংখ্যক বদলিতে নতুন কর্মস্থলে অচেনা অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে গিয়ে খেই হারাচ্ছে থানা পুলিশ। এছাড়া আগস্টে থানা থেকে লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র এখনো অপরাধীদের হাতে থাকায় উদ্বেগ আছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশি নিষ্ক্রিয়তায় চুরি-ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়েছে। গত মাসে যৌথবাহিনী পরিচয়ে মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে ঢুকে ৬০ ভরি স্বর্ণ ও ৭৫ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। গত ৩০ অক্টোবর ধানমন্ডির একটি বাড়িতে ডাকাতি হয়।
এছাড়া গত ৩০ অক্টোবর জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার একটি গ্রামে সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে বাড়িতে ঢুকে ঘর তল্লাশি করার নামে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের ঘটনা ঘটে। তার আগে ২০ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দৌলতদিয়াড়ে অঞ্জলি রানী বিশ্বাস (৫৫) নামে এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। লুট হয় নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের চর এলাকায় মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল আঁতকে ওঠার মতো। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানা হেঁচড়া, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন।
ওই এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের পর মোহাম্মদপুরের দৃশ্য বলে বোঝানোর মতো নয়। কে ডাকাত বা ছিনতাইকারী তা বোঝা মুশকিল ছিল। দলবদ্ধ কিশোর গ্যাং কালচার, হামলা, প্রকাশ্য ছিনতাই ছিল আতঙ্কজনক। সেটা কিছুটা কমেছে এখন। কিন্তু ছিনতাই এখনো হচ্ছে।
দশ মাসে খুনের মামলা সর্বোচ্চ সেপ্টেম্বরে
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৪৬০টি, এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৮টি।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, নানা অপরাধে হওয়া মামলার পরিসংখ্যানে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বেশি। ডিএমপি গতিশীলতায় ফিরছে। মামলা হচ্ছে, আসামিও গ্রেপ্তার হচ্ছে। ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিযানে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। নভেম্বরে তুলনামূলক পরিবর্তন আসছে, রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
ছিনতাই কমলেও বেড়েছে ডাকাতি
গত তিন মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে চুরির ঘটনা ঘটেছে ১৭৭১টি। এর মধ্যে জুলাই মাসে চুরির ঘটনা ৭৮৫টি, আগস্টে ৩৮১টি, সেপ্টেম্বরে ৬০৫টি।
তিন মাসের পরিসংখ্যান বলছে, ডাকাতির ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তিন মাসে ডাকাতির ঘটনা ১২১টি। জুলাইয়ে ছিল ২৭টি, আগস্টে ৩৭টি এবং সেপ্টেম্বরে ৫৭টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, পরিসংখ্যান দিয়ে অনেক কিছু দেখানো সম্ভব, আবার অনেক কিছু সম্ভব না। তবে দৃশ্যমান অনেক পরিবর্তন এসেছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশ যে স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে গেছে তা থেকে পুলিশ এখন স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটা অপরাধমূলক ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত মাসের ১৮ তারিখ থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তাতে অনেক অপরাধী ধরা পড়ছে।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধকতা গণবদলি
ঢাকার অপরাধ জগতে নজরদারি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চৌকস ও অভিজ্ঞ জনবল দরকার। সেখানে গণহারে ডিএমপির সিনিয়র থেকে জুনিয়র সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ঢাকার আইন-শৃঙ্খলায়। বেড়েছে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে একটু উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আরও উন্নতি হওয়া দরকার। খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যে চলে গেছে তা না। এখন যদি বলেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন? বলব জাস্ট সন্তোষজনক, কিন্তু এটা আরও ভালো হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, যেহেতু ঢাকার প্রায় সব পুলিশকে আমরা চেঞ্জ করছি। তাদের কিন্তু অলিগলি চিনতে সময় লাগবে। তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক গড়তে সময় লাগবে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুর মোহাম্মদ বলেন, বদলি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা এখন কীভাবে কোন ক্রাইটেরিয়া মেনে করা হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। আগে পুলিশ নিয়ে আতঙ্ক ছিল। এখন পুলিশই আতঙ্কে আছে। সেই ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে তো একটু সময় লাগবে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারের দোসর কি শুধু পুলিশই ছিল, আরও তো সংস্থা, বাহিনী, বা প্রতিষ্ঠান আছে। তাহলে শুধু পুলিশের ওপর ধাক্কাটা বেশি এলো কেন? কারণ পুলিশই ছিল ফ্রন্টলাইনে। সঙ্গত কারণে পুলিশকেই বেশি জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হয়েছে। মুখ দেখে বা দল-মত চিনে নয়, দক্ষ, নেতৃত্বের গুণাবলি আছে, গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আনতে হবে। এখন পুলিশের কাজ হবে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো; মানুষকে সেবা দেওয়া; অপরাধ নির্মূলে অধিক গুরুত্ব দেওয়া।
Sharing is caring!