প্রজন্ম ডেস্ক:
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, চুলচেরা ব্যয় বিশ্লেষণ ও সঠিক তদারকির কারণে দুটি রেল প্রকল্পেই ব্যয় কমছে সাত হাজার ৩২০ কোটি টাকা। অন্য তিনটি প্রকল্পেও ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে অন্তত পাঁচটি প্রকল্প থেকে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমাচ্ছে সরকার।
‘আপাতত প্রয়োজন নেই’ এমন কাজ বাদ
চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ছয় হাজার ৬৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে। মূল প্রকল্প থেকে ব্যয় কমেছে ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ব্যয় কমানো হয়েছে ৬২১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রেলের ব্যয় সংকোচন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। চলমান প্রকল্পগুলো নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অন্তত পাঁচটি প্রকল্প থেকে ব্যয় কমছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ঠিক রেখে ‘আপাতত প্রয়োজন নেই’ এমন কাজগুলো বাদ দেওয়া হচ্ছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এরই মধ্যে ব্যয় কমানোর চূড়ান্ত প্রস্তাবনায় সই করেছেন। মূলত এসব প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, পূর্ত প্যাকেজ, পুনর্ভরণযোগ্য সিডি-ভ্যাট, পরামর্শক নিয়োগ ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ আনুষঙ্গিক খাত থেকে ব্যয় কমানো হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) কবির আহামদ বলেন, সবচেয়ে বেশি ব্যয় কমছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পে। আমরা প্রকল্পের নানান খাতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। প্রথমে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমার তাদের অংশে রেলপথ নির্মাণ না করায় বাংলাদেশের ওই অংশটুকুর কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পেও ব্যয় কমানো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া আরও কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হচ্ছে। সেখানেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় কমছে। যেমন- যমুনা নদীর ওপর রেলসেতুসহ বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে। ঠিকাদাররাও ব্যয় কমিয়েছেন। এখন কিন্তু ঠিকাদারদের ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয় না। এসব কারণে ব্যয়ও কমছে।
৬৬৯৮ কোটি ব্যয় কমছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় কমছে ৬ হাজার ৬৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পের সবশেষ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এখন ব্যয় কমে দাঁড়াচ্ছে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বাংলাদেশ অংশে ২৫ কিলোমিটার রুট বাদ দেওয়ায় ব্যয় কমছে প্রায় তিন হাজার ১৫৬ কোটি টাকা।
এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণে এক হাজার ২৫৫ কোটি, ক্ষতিপূরণ খাতে ৩২৬ কোটি ৪০ লাখ, সিটি ভ্যাট খাতে ৫৯৬ কোটি ৭৭ লাখ, পরামর্শক খাতে ২৩৫ কোটি ২২ লাখসহ সব মিলিয়ে ব্যয় কমছে ৬ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। এ কারণে প্রকল্পের সংশোধন করা হচ্ছে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
কাজের পরিধি বাড়লেও কমছে ব্যয় সংশোধন
প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্প এলাকাভুক্ত কক্সবাজার স্টেশন ছাড়া অন্য স্টেশনগুলোতে ফুটওভার ব্রিজের সংস্থান ছিল না। নিরাপদ যাত্রী পারাপার এবং যাত্রীসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে প্রকল্প এলাকার আটটি স্টেশনে নতুন করে আটটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের সংস্থান রাখা হয়েছে।
কক্সবাজারে একটি আইকনিক স্টেশন নির্মাণ করায় ওই স্টেশনে সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করতে সাব-স্টেশনের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশনের ক্যাপাসিটি ৬০০ কেভিএ-র পরিবর্তে ২০০০ কেভিএ-তে উন্নীতকরণের সংস্থান রাখা হয়েছে। প্রকল্প এলাকাভুক্ত সড়ক ও রেলপথের সংযোগস্থলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেভেলক্রসিংয়ের সংস্থান রাখা হয়। নিরাপদ ট্রেন চলাচল ও যাত্রীসেবা নিশ্চিতকরণ এবং সড়কপথের যানবাহন ও রেলের সংঘর্ষ এড়াতে প্রকল্প এলাকাভুক্ত ৪৬টি লেভেলক্রসিংয়ের পরিবর্তে সড়ক আন্ডারপাস নির্মাণের সংস্থান রাখা হয়েছে।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্প এলাকাভুক্ত চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া অংশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং বান্দরবান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে অস্বাভাবিক বন্যা দেখা দেয়, যা ছিল বিগত ৫০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ। এতে প্রকল্প এলাকার অনেক স্থানে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে নতুন করে চারটি বক্স কালভার্ট নির্মাণের সংস্থান রাখা হয়েছে।
প্রকল্পের মূল কার্যপরিধিতে বিভিন্ন স্টেশনে ৫০ মিটার প্ল্যাটফর্ম শেডের সংস্থান রাখা হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মে কোনো শেডের সংস্থান ছিল না। সেখানে নিরাপদ যাত্রীসেবা এবং আরামদায়ক ভ্রমণ নিশ্চিত করতে প্রতিটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শেডের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১০০ মিটার এবং দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মেও ১০০ মিটার শেড নির্মাণের সংস্থান রাখা হয়েছে। কক্সবাজারের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনে নির্মিত রেস্ট-হাউজটি দোতলা থেকে পাঁচ তলায় উন্নীত করা হবে।
ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, বন বিভাগের ভূমি পেতে বিলম্বসহ অন্য অনেক কারণে প্রকল্পের পূর্তকাজ শেষ করতে তিন বছরের পরিবর্তে প্রায় পাঁচ বছর সময় ব্যয় হয়। সে কারণে আনুপাতিক হারে পরামর্শক সেবার জন-মাস বেড়ে যায়। তবে সার্বিকভাবে পরামর্শক সেবার ব্যয় কমেছে।
৬২১ কোটি টাকা ব্যয় কমছে পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পে
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের সবশেষ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এখন ব্যয় কমে দাঁড়াচ্ছে ৩৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুনে মেয়াদে শেষ হওয়ার কথা ছিল। নতুন করে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়বে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন; ঢাকা-যশোর করিডোরে অপারেশনাল সুবিধাদির উন্নয়নসহ সংক্ষিপ্ত রুটে বিকল্প রেল যোগাযোগ স্থাপন; বাংলাদেশের মধ্যে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি উপ-রুট স্থাপন করা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা নতুন করে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
প্রকল্প ঋণ কমানো ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত কারণে ব্যয় বেড়েছে ৭১১ কোটি টাকা। এনবিআর প্রকাশিত সার্কুলার অনুযায়ী, আইটি ভ্যাটের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে এ খাতে বেড়েছে ৫০৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিদেশ থেকে আমদানি করা মালামালে সিডি-ভ্যাটসহ সব ধরনের ট্যাক্স সরকারের নির্বাহ করতে হবে। তাই পূর্ত কাজের মালামাল বিদেশ থেকে আমদানির জন্য সিডি-ভ্যাট খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন ব্যয় হ্রাস
মাঠ পর্যায়ে প্রকৃত ব্যয়ের আলোকে ভূমি অধিগ্রহণ খাতের ব্যয় হ্রাস করা হয়েছে। বর্তমানে ভূমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে, তাই এ খাতে ১১৭২ দশমিক ২৭ কোটি টাকা ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া পুনর্বাসন খাতে ৩৪২ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয় কমছে। মূল ডিপিপিতে যে পরিমাণ জনবলের সংস্থান রাখা হয়েছিল সে পরিমাণ জনবল পদায়িত না হওয়ায় সম্পদ ক্রয়, প্রশাসনিক ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় কমছে ১৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে ইউটিলিটি শিফটিং যথা- পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, অপটিক্যাল ফাইবার ইত্যাদি ইউটিলিটি স্থানান্তর বাবদ ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায় পরামর্শক খাতে ব্যয় বেড়েছে ৩০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় ৬২১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা কমানো হয়েছে।
আরও তিন প্রকল্পে কমছে ১২শ কোটি টাকা
এছাড়া আখাউড়া-লাকসাম রেল প্রকল্পে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা, খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ১০০ কোটি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় কমছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মোট পাঁচটি প্রকল্পের সাশ্রয় হওয়া সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) শেখ সাকিল উদ্দিন আহমদ বলেন, নানা কারণে সার্বিকভাবে পাঁচটি প্রকল্পের ব্যয় কমছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় কমছে কক্সবাজার-দোহাজারি রেলপথে। পদ্মারেল সংযোগসহ আরও কিছু প্রকল্পের ব্যয় কমছে। সব প্রকল্পের ডিপিপি পুনরায় বিশ্লেষণ করেই ব্যয় কমানো হয়েছে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com